দেশের আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মিন্নি ও নয়ন বন্ড।
নিজেদের প্রেমের সম্পর্কে বাধা দূর করার জন্যই মিন্নি নিজ স্বামী রিফাতকে
হত্যার পরিকল্পনা করেন বলে এই মামলার চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায়
আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ২৪ জন আসামির বিরুদ্ধে পুলিশের দাখিল করা
চার্জশিটে স্বাক্ষর করেছেন আদালত। বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের
বিচারক মো. সিরাজুল ইসলাম গাজী সোমবার বিকেলে ১২৩২ পৃষ্ঠার চার্জশিটে
স্বাক্ষর করেন।
চার্জশিটে মিন্নির বিরুদ্ধে ‘হত্যার ষড়যন্ত্রের’
অভিযোগ আনা হয়েছে। চার্জশিটে রিফাত হত্যার আগে ও পরে মিন্নির সাথে ঘাতক নয়ন
বন্ড ও রিফাত ফরাজির সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ হয়েছে বলে উল্লেখ করা
হয়েছে। এছাড়াও চার্জশিটে রিফাতকে নয়ন বন্ডরা কুপিয়ে জখম করার পরও নয়ন
বন্ডের সঙ্গে ফোনে ও ক্ষুদে বার্তায় মিন্নির যোগাযোগের কথা উল্লেখ করা
হয়েছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তার আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে মিন্নির
বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিপরীতে নয়ন বন্ডের মায়ের নামে নিবন্ধিত একটি সিম
গোপনে মিন্নি ব্যবহার করত, এমন অভিযোগ এনে ওই নম্বরের সঙ্গে নয়ন বন্ডের
বিভিন্ন সময়ে কল লিস্ট ও কল ডিটেইলস জমা দেয়া হয়েছে আদালতে।
এছাড়াও আলামত হিসেবে নিহত নয়ন বন্ডের বাসা থেকে জব্দ স্যালোয়ার কামিজ, আই
ভ্রু, মিন্নির ছবি, মাথা আচড়ানো চিরুনি, চিরুনিতে পেচানো নারীদের চুল জমা
দেয়া হয়েছে। চার্জশিটে বিবরণীতে অধিকাংশ জায়গায় মিন্নির বিরুদ্ধে রিফাত
হত্যায় ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে।
নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির
সম্পর্কে সৃষ্ট বিরোধীতার জেরেই রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে মিন্নি ও নয়ন
বন্ড এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে। বিবরণীতে বলা হয়, প্রথমে মিন্নি
নয়নকে বিয়ে করে। বিষয়টি গোপন রেখে ফের রিফাত শরীফকে বিয়ে করে মিন্নি এবং
নয়ন বন্ডের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ ও বাসায় যাতায়াত অব্যাহত রাখে। এ নিয়ে
রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়। সবশেষ হেলাল নামের এক
যুবকের কাছ থেকে রিফাত শরীফের মোবাইলফোন কেড়ে নেয়া থেকে নয়নের সঙ্গে
রিফাতের দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ নেয়। সবমিলিয়ে মিন্নি ও নয়ন বন্ড মিলে রিফাত
শরীফকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বরগুনার পাবলিক
প্রসিকিউটর ভূবন চন্দ্র হাওলাদার দন্ডবিধি আইনের ১২০-বি (১) ধারা সম্পর্কে
জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধারায় কেউ অপরাধ সংগঠিত করলে তার বিরুদ্ধে আনীত
অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন কারাবাস বা দুই বছর বা ততোধিক
মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডে দ-িত হতে পারেন। আদালত অপরাধ বিবেচনায় এর যে কোনো
একটি শাস্তি দিতে পারেন।
মিন্নির আইনজীবী মো. মাহবুবুল বারি আসলাম
বলেন, মামলার শুরু থেকে পুলিশের তদন্ত যে প্রক্রিয়ায় এগিয়েছিল, আমরা
সন্তুষ্ট ছিলাম। এই মামলার বাদীকে ভিকটিম রিফাত শরীফ মৃত্যুর আগে
জবানবন্দিতে মিন্নিকে সাক্ষী করতে বলেছেন বলে আমরা জেনেছি। সেভাবেই মামলাটি
দায়ের করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই মাঝপথে নাটকীয় মোড় নিয়ে এখন যে পর্যায়ে
এসে চার্জসীট হয়েছে, এটা সত্যি দুঃখজনক। উচ্চ আদালত মিন্নিকে জামিন দেওয়া
এবং জামিনের আদেশ পরবর্তী চার পৃষ্ঠার রায়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য ও
নির্দেশনার পরপরই হঠাৎ এ চার্জসীট দাখিল আমাদের অবাক করেছে। মূলত মিন্নির
জামিন বাতিলে আপিলের গ্রাউন্ড তৈরি করাই এর উদ্দেশ্য ছিল।
মামলার
তদন্ত র্কমর্কতা মো. হুমায়ুন কবরি বলেন, মিন্নির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তি
এবং হত্যাকাণ্ডে সহায়তা, পরকিল্পনাসহ সুনর্দিষ্টি প্রমাণ পাওয়ায় মিন্নিকে
মামলার সাত নম্বর আসামি করা হয়েছে। আমরা নিরবিচ্ছন্ন ও গভীর তদন্তরে পর
রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মামলায় চার্জসীট আদালতে দাখিল করেছি।
অন্যদিকে
মিন্নির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে তার পরিবার।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, একটি কুচক্রী মহলের ইন্ধনে
পুলিশ এই মামলায় মিন্নিকে আসামি করেছে।
রিফাত শরীফ হত্যা মামলায়
পুলিশের দাখিল করা মূল চার্জসীট দুটি খণ্ডে মোট ৩৪ পৃষ্ঠার। এর প্রথম খণ্ডে
মিন্নিসহ অন্য ১ জনের বিরুদ্ধে একটি খ- ১৬ পৃষ্ঠার এবং কিশোর অপরাধীদের
অভিযোগ পত্র ১৮ পৃষ্ঠার। এছাড়াও ১৫ জন আসামির ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৬৪
ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও মামলায় ফৌজদারী
কার্যবিধির ১৬১ ধারায় বিভিন্ন সময়ে পুলিশের গ্রহণ করা ৭৫ জন সাক্ষীর
জবানবন্দি, ৫০ টির বেশি আলামতের জব্দ তালিকা ও বিভিন্ন সময়ে আসামিদের
ব্যবহৃত মুঠোফোনের কল ডিটেইলস চার্জশিটের সঙ্গে আদালতে জমা দেয়া হয়েছে।
আলামত
হিসেবে একটি স্যামসাং ও একটি একটি ধূসর রঙের অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোন, হত্যায়
ব্যবহৃত রামদা, বন্ড ০০৭ গ্রুপের সদস্যদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের প্রোফাইল
ছবির একটি স্ক্রিনশট, ঘটনার বিষয়ে বিভিন্ন স্ট্যাটাসের কপি ১২ কপি
স্ক্রিনশট, বন্ড ০০৭ গ্রুপের ১১ জন সদস্যের প্রোফাইল ছবির ১১টি স্ক্রিনশট,
বন্ড ০০৭ গ্রুপের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে দেয়া ১১ জন সদস্যের ম্যাসেজের ১১ কপি
স্ক্রিনশটের প্রিন্টেড কপি জমা দেয়া হয়েছে।
পুলিশের নির্ভরযোগ্য
সূত্রের তথ্যমতে বয়সের ভিত্তিতে দাখিল করা দুই খণ্ডের চার্জশিটের প্রথম
খন্ডে মিন্নিসহ ১০ জন আসামী রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে রিফাত ফরাজীকে এক নম্বর
আসামি করা হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে ১৪ জন কিশোরের নাম। এতে রিফাত
ফরাজীর ছোট ভাই রিশান ফরাজীকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে।
মিন্নির
জামিন শুনানীর জন্য বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ মামলার মূল নথি রয়েছে।
বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে থেকে মূল নথি আসার পর বরগুনা সিনিয়র
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগের উপর শুনানি শেষে আদালত ওই
চার্জসীট গ্রহণ করলে পরবর্তী বিচারিক কার্যক্রম শুরু হবে।
চার্জশিটে
২৪ আসামির মধ্যে ৯ জন পলাতক এবং বাকি ১৫ জন কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে
প্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হলেন, মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল
কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী
খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯), মো. মুসা (২২), আয়শা
সিদ্দিকা মিন্নি (১৯), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল
হাসান সায়মুন (২১)। অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হলেন, মো. রাশিদুল হাসান রিশান
ওরফে রিশান ফরাজী (১৭), মো. রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার (১৫), মো. আবু
আবদুল্লাহ্ ওরফে রায়হান (১৬), মো. ওলিউল্লাহ্ ওরফে অলি (১৬), জয় চন্দ্র
সরকার ওরফে চন্দন (১৭), মো. নাইম (১৭), মো. তানভীর হোসেন (১৭), মো. নাজমুল
হাসান (১৪), মো. রাকিবুল হাসান নিয়ামত (১৫), মো. সাইয়েদ মারুফ বিল্লাহ ওরফে
মহিবুল্লাহ (১৭), মারুফ মল্লিক (১৭), প্রিন্স মোল্লা (১৫), রাতুল শিকদার
জয় (১৬) ও মো. আরিয়ান হোসেন শ্রাবণ (১৬)।