বাংলাদেশের বেন স্টোকস হবেন কে? প্রেসবক্সে এক সাংবাদিকের এ প্রশ্নে
আরেকজনের রসাত্মক উত্তর— বাংলাদেশের কেউ এই টেস্টে বেন স্টোকস হবেন কি না
জানি না তবে দলের ‘ব্রেন স্ট্রোক’ হয়ে গেছে! স্পিনাররা যেভাবে বোলিং করলেন,
ব্যাটসম্যানরা যেভাবে ব্যাটিং করছেন, দলের যা কৌশল—সব দেখে মনে হচ্ছে
সমস্যাটা আসলে ভাবনা বা মস্তিষ্কে!
কদিন আগে হেডিংলিতে দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডকে জিতিয়েছেন বেন
স্টোকস। অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৫৯ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ইংলিশ অলরাউন্ডার
খেললেন অপরাজিত ১৩৫ রানের এক ইনিংস। ইতিহাসের মহানায়কই হয়ে গেলেন সেই
ইনিংস দিয়ে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে স্টোকসের মতো একটা
ইনিংস খেলতে পারবেন বাংলাদেশের কেউ? কাজটা কঠিন, খুব কঠিন।
৩৯৮
রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ওপেনার লিটন দাস দ্রুত ফিরে গেলে আফগান
উইকেটকিপার আফসার জাজাই উইকেটের পেছন থেকে বলে উঠলেন ‘এবার দ্বিতীয়টা শিকার
করা যাক।’ চোখের পলকে দ্বিতীয় উইকেটটাও পেয়ে গেল আফগানরা। এভাবে তৃতীয়,
চতুর্থ, পঞ্চম… আফগানিস্তানের বোলাররা যেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের
বলে-কয়ে আউট করতে নেমেছেন!
বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে ঝিরিঝিরি বর্ষণে ছাতা হাতে সাকিব-সৌম্য মাঠ ছাড়ার
আগে বাংলাদেশের স্কোর ৬ উইকেটে ১৩৬। বৃষ্টির আশা আর স্টোকসের মতো অতিমানবীয়
কিছু করা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোনো পথ খেলা নেই। আফগানিস্তানের
দুর্দান্ত স্পিন আক্রমণের সামনে বাকি ৪ উইকেট নিয়ে পুরো একটা দিন ৯৮ ওভার
টিকে থাকা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি!
কাল
মেহেদী হাসান মিরাজ বারবার বলছিলেন, অসম্ভবকে সম্ভব করার ঘটনা ক্রিকেটে তো
নেহাতই কম নেই। কম নেই, ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশকে কেন আফগানিস্তানের মতো
নবীন এক টেস্ট দলের বিপক্ষে অসম্ভব কিংবা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয়? এ
প্রশ্নে মিরাজ কাল অদ্ভুত এক যুক্তিই দিয়েছেন, ‘ওরা মাত্র শুরু করেছে টেস্ট
ক্রিকেটে খেলা। ওরা চাইবেই যেন বিশ্বকে ভালো কিছু করে দেখাতে পারে। এ
কারণে ওদের রোমাঞ্চ বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক।’
আফগানদের রোমাঞ্চ আছে, বাংলাদেশের নেই? একটা দল তিন নম্বর টেস্ট খেলতে
নেমে র্যাঙ্কিংয়ে তাদের ওপরের দলকে হারিয়ে দিচ্ছে, ১৯ বছরে বাংলাদেশ তাহলে
টেস্টে কী শিখেছে? এটা ঠিক স্কিলে আফগানিস্তানের স্পিনাররা বাংলাদেশের
তুলনায় বেশ এগিয়ে। খুব যে টার্ন তাঁরা পাচ্ছেন তা নয়, ‘চায়নাম্যান’ জহির
খানই যেমন ৩ ডিগ্রির বেশি বাঁক পাননি। গুগলিতে বাঁক পাচ্ছেন গড়ে ২.৪ আর লেগ
ব্রেক ৩.২ ডিগ্রি। রশিদ খানও প্রায় তাই। উইকেটে টার্ন বেশি না থাকায় তাঁরা
দুটি দিকে বেশি জোর দিয়েছেন—গতির হেরফের করে ঠিক জায়গায় ধারাবাহিক বোলিং
করা। এই টেস্টে আফগান স্পিনাররা গড়ে ঘণ্টায় ৮৫.৭ কিলোমিটার গতিতে বোলিং
করছে, বাংলাদেশের স্পিনাররা সেখানে ৮১ কিলোমিটার গতিতে। নবী-রশিদ কখনো ৯০+,
কখনো সেটি ৮০ কিলোমিটার। আর তাতেই খবর হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের
ব্যাটসম্যানদের।
স্কিলে না হয় আফগানিস্তানের স্পিনাররা এগিয়ে, কিন্তু সেটি তো বাংলাদেশ
উতরে যেতে পারত অভিজ্ঞতায়। ১৯ বছর যে দল টেস্ট খেলছে তাদের কি টেস্টের এ
আঁকাবাঁকা পথ অজানা? তবুও কেন ধৈর্যের পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে বসছেন
ব্যাটসম্যানরা। বোলাররা উইকেটের সহায়তার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকেন, কেন
অ্যাকুরিসি ঠিক রেখে ধারাবাহিক বোলিং করতে পারেন না?
এই টেস্টের আগে দুই সপ্তাহের কন্ডিশনিং ক্যাম্প করেছে বাংলাদেশ, নিজেদের
মধ্যে দুদিনের প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে। কিন্তু তাতেই কি হয়ে গেল? সাদা
পোশাকে বাংলাদেশ খেলতে নেমেছে ছয় মাস পর। নেটে ছিল না একজন রশিদ খান-জহির
খানের মতো ভালো মানের বোলার। বাংলাদেশ দলের অন্তত চার-পাঁচজনের
ব্যাটসম্যানের কি উচিত ছিল না এমএ আজিজে আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুদিনের
প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলা? খেললে রশিদ-জহিরদের সম্পর্কে ধারণাটা নিশ্চয়ই আরও
পরিষ্কার থাকত তাঁদের।
দুই দলের অনেক পার্থক্যই যেন ঠিক করে দিয়েছে চট্টগ্রাম টেস্টের পরিণতি।
পার্থক্য প্রস্তুতিতে, পার্থক্য স্কিলে, পরিকল্পনায়। এখানে শুধু একটি
জায়গায় পরিষ্কার এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ—অভিজ্ঞতা। ১৯ বছরের অভিজ্ঞতা। সেটিই
কাজে লাগাতে না পারার অর্থ ক্রিকেট-সিস্টেমে বড় গলদ আছে। সাময়িক সাফল্যে এ
গলদ ঢাকা পড়লেও সেটি প্রায়ই ফোকলা হয়ে পড়ে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই
টেস্টে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে আবারও দেখিয়ে দিল।