শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি তারল্য জোগান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে দুদিন সূচকের উত্থান হলেও সেটি স্থায়ী হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের অধ্যাপক মিজানুর রহমান


বাংলা নিউজ: চলতি বছরের শেয়ারবাজারের আচরণকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাজার স্বাভাবিক আচরণ করছে বলে মনে করেন কি?
মিজানুর রহমান: শেয়ারবাজারের গত প্রায় এক বছরের আচরণ যদি মূল্যায়ন করি, তাহলে বলা যায়, বাজারের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে। ব্যাপক দরপতনে ভালো-মন্দ সব ধরনের শেয়ারের দাম কমেছে। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অনেকে বাজার ছেড়ে গেছেন। এ সময়ে বাজারে ব্যাপকভাবে তারল্যসংকট দেখা দিয়েছে। এর পেছনে বেশ কিছু বিষয় বড় ভূমিকা রেখেছে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল চলতি হিসাবের ঘাটতি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খোলাবাজারে ডলার বিক্রি এবং প্রাইমারি বাজারের তথা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও বাজারের দৈন্যদশা। গত ১০ বছরে ১০০টির মতো আইপিও বাজারে এসেছে। এর বেশির ভাগের দামই বর্তমানে শুরুর দিনের তুলনায় অনেক নিচে। মানহীন নানা কোম্পানিকে বাজারে এনে আমরা প্রাইমারি বাজারটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছি। এর দায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জ—উভয়কেই নিতে হবে। কারণ, তাদের দায়িত্ব ছিল বাজারে ভালো কোম্পানি নিয়ে আসার। কিন্তু তারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া আছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক তারল্যসংকট, সুশাসনের অভাব, বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট আর কারসাজির ঘটনা।
বাংলা নিউজ: কিন্তু যেসব কোম্পানি বাজারে এসেছে, তার বেশির ভাগই তো অভিহিত মূল্যে বাজারে এসেছে। অনেকগুলোর দামও এখনো অভিহিত মূল্যের ওপরে আছে। তাহলে আপনি কীভাবে বলছেন, এসব কোম্পানি বাজারে আসার পর খারাপ হয়েছে?
মিজানুর রহমান: অভিহিত মূল্যে তালিকাভুক্ত হলেও অতিমূল্যায়িত হতে পারে। নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধনের দিকে তাকালে দেখবেন যে তালিকাভুক্তির আগের এক বা দুই বছরে তারা স্টক লভ্যাংশের মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন ও শেয়ারের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি করে। সম্পদের অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে শেয়ার মূলধনকে অতিমূল্যায়ন করে। শেয়ারপ্রতি নিট অ্যাসেট ভ্যালুকে (ন্যাভ) অতিরঞ্জিত করে। প্রসপেক্টাসে দেখানো ভবিষ্যৎ আয় ও শেয়ারপ্রতি মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা প্রায়শই অসত্য প্রমাণিত হয়। প্রকৃত চিত্র হলো, বিগত ১০ বছরে তালিকাভুক্ত শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের একটি বিরাট অংশ বর্তমানে প্রাথমিক প্রস্তাবিত মূল্যের অনেক নিচে কেনাবেচা হচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীরা মূলধন হারিয়েছে। ভালো কোম্পানি বলতে আমরা বুঝি, যাদের ক্রমাগত ভালো ব্যবসা হবে এবং আয় ও শেয়ারপ্রতি মুনাফায় ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি থাকবে, বছর শেষে ভালো লভ্যাংশ দেবে। গত ১০ বছরে আসা অধিকাংশ কোম্পানিরই এসব ক্ষেত্রে কোনো ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি নেই। দেশে এমন কোনো অবস্থা হয়নি, যার জন্য আইপিওতে আসার কয়েক বছরের মধ্যে কোম্পানির আয় কমবে, ব্যবসা খারাপ হবে। কিছু কিছু কোম্পানি তো বাজারে আসার কয়েক বছরের মধ্যে কার্যত বন্ধও হয়ে গেছে। এসব কোম্পানি বাজারে আসার আগে স্থিতিপত্র বা ব্যালান্সশিটে, সম্পদের পরিমাণকে অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছে বলে এমনটি হয়েছে। ফলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারা ন্যায্যমূল্যের চেয়ে বেশি দামে বাজারে তালিকাভুক্তির সুযোগ পেয়েছে। তালিকাভুক্তির পরে তাদের উৎপাদন, আয়, পরিচালন, নগদ প্রবাহ বা শেয়ারপ্রতি আয়ের ওপর তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না। অনেক সময় উপর্যুক্ত সূচকসমূহে অবনমন হয়েছে। আমার গভীর সন্দেহ রয়েছে, কোম্পানিগুলো বাজার থেকে সংগ্রহ করা মূলধনের অপব্যবহার করেছে কি না। আবার কিছু কোম্পানি বাজার থেকে টাকা তুলে ঋণ পরিশোধ করেছে। এটিও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থপরিপন্থী।
বাংলা নিউজ: অভিহিত মূল্যে কোনো কোম্পানি বাজারে আসতে চাইলে সেটির দাম কমানোর তো সুযোগ নেই। তাহলে কি আইপিও আসা বন্ধ করে দেওয়াকে আপনি সমাধান মনে করছেন?
মিজানুর রহমান: অভিহিত মূল্যে তালিকাভুক্ত হতে হবে, এটাই একটা কালাকানুন এবং শেয়ারবাজার উন্নয়নের পরিপন্থী। একটি সুশাসিত কোম্পানি যার ব্যবসায়ে প্রবৃদ্ধি আছে, তাকে প্রিমিয়ামে তালিকাভুক্তির সুযোগ দিতে হবে। মনে রাখবেন, কোনো শেয়ারের ন্যায্যমূল্য অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি বা কম হতে পারে। তা নির্ভর করে মূলত কোম্পানির ভবিষ্যৎ শেয়ারপ্রতি আয় ও তার প্রবৃদ্ধির ওপর। যেসব কোম্পানি গত ১০ বছরে বাজারে এসেছে, তাদের বেশির ভাগই বাজারে আসারই উপযোগী নয়। যে কোম্পানি বাজারের জন্য ভালোর চেয়ে খারাপ করছে বেশি, সে ধরনের কোম্পানিকে বাজারে আসার সুযোগ দেওয়ার চেয়ে না দেওয়াই শ্রেয়। বাজারে নতুন কোম্পানি আনতে হবে, তবে সেটি হতে হবে অবশ্যই সুশাসিত এবং ভালো মানের। গত কয়েক বছরে বাজারে আসা অনেক কোম্পানির আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যও কিছু কিছু কোম্পানির জন্য অতিমূল্যায়িত দাম। কারণ, তারা শুধু বাজারে আসার জন্যই মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের নানা সম্পদ, আয়-ব্যয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। যেগুলোর বাস্তব ভিত্তি নেই। এ ধরনের কোম্পানিগুলো বাজারে এসেছে মূলত বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নিতে। অনেক কোম্পানি অভিহিত মূল্যে বাজারে আসার জন্য হিসাবের কারসাজির আশ্রয় নিয়েছে। কোম্পানিগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়েছে আর কিছু নিরীক্ষক তা জাস্টিফাই করেছে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো প্রশ্নই তোলেনি।
বাংলা নিউজ: শেয়ারবাজারে উন্নয়নে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবু বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না কেন?
মিজানুর রহমান: শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা না ফেরার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে—ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের তারল্যসংকট ও চড়া সুদের হার, করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি, কারসাজি ও পণ্যবৈচিত্র্য না থাকা। বিনিয়োগযোগ্য কোম্পানি হাতে গোনা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অভাব। মিউচুয়াল ফান্ডের দৈন্যদশা। অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ বন্ড মার্কেট না থাকাও অন্যতম ঘাটতি। এত সব সমস্যা যে বাজারে বিদ্যমান, সেখানে বিনিয়োগকারীরা কখনোই বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসবেন না। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার যত বেড়েছে, শেয়ারবাজারে আকার তার তুলনায় কমেছে। তার মানে, এ বাজারে বিনিয়োগ আসছে না। ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরও শেয়ারবাজারে লেনদেন ৪০০ কোটি টাকায় নেমে যাওয়া কখনোই শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য সাফল্যের সূচক হতে পারে না।
বাংলা নিউজ: আপনি কারসাজির কথা বলছিলেন, একটু ব্যাখ্যা করবেন কি?
মিজানুর রহমান: দেখুন, সেকেন্ডারি বাজারে আমরা সচরাচর খালি চোখেই কারসাজির ঘটনা দেখতে পাই। এসব কারসাজিতে কোম্পানির লোকজনও জড়িত থাকে। কিন্তু কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির নেই। বরং আমি মনে করি, কারসাজির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শাস্তির নামে পুরস্কৃত করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কারণ, কারসাজির মাধ্যমে একজন কারসাজিকারী যে মুনাফা করেন, তার ১০ ভাগের ১ ভাগ জরিমানা করা হয় তাঁকে। একজন কারসাজিকারী যখন ১০০ টাকা মুনাফা করে ১০ টাকা জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যান, তখন তিনি আবার কারসাজিতেই বেশি আগ্রহী হবেন। আমাদের বাজারে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলো কারসাজির বড় হাতিয়ার। কারণ, সেগুলোর লেনদেনযোগ্য শেয়ারসংখ্যা খুবই কম। অল্প কিছু শেয়ার কিনেই এ ধরনের কোম্পানির শেয়ারের ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো যায়। এরপরও জেনেবুঝে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমন সব কোম্পানিকে বাজারে তালিকাভুক্ত থাকার অনুমোদন দিচ্ছে। এসব কোম্পানির লেনদেনযোগ্য শেয়ারের অনুপাত ন্যূনতম ২০-২৩ শতাংশ করলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজির সুযোগ কম পাবেন। করপোরেট বোর্ডে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করতে হবে। অডিট কার্যক্রম তদারক করতে হবে।