একটা সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ব্যস্ত অভিনেতা। সেসব এখন
শুধুই ফেলে আসা অতীত। চলচ্চিত্রে ব্যস্ততা বলতে কিছুই নেই। আগে সময় পেলে
বিকেলে ছুটে যেতেন কাকরাইল ফিল্ম পাড়ায়, এফডিসিতে। সহশিল্পীদের সঙ্গে আড্ডা
দিয়ে সময় কাটাতেন। এখন সেটাও পারেন না। এখন সারা দিন বাসায় বই,
পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশন দেখেই দিন কাটে প্রবীর মিত্রের। যে চলচ্চিত্রের
জন্য জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করেছেন, সেখানকার দু-একজন ছাড়া আর কেউ
খোঁজখবর নেন না বলে জানালেন তিনি।
দীর্ঘদিন অর্থারইটিজ সমস্যা, বিশেষ করে দুই হাঁটুর তীব্র অসুস্থতার
কারণে প্রবীর মিত্র এখন ঘরের চার দেয়ালে বন্দী হয়ে প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন
করছেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। এই
রোগের ফলে তাঁর হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। যন্ত্রণাদায়ক এই রোগের জন্য ঠিকমতো
হাঁটতে পারেন না তিনি। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড ব্যথায় ভোগেন, আবার কদিন ভালো
থাকেন। তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় আমার সিনেমায় কাজ করার মতো পরিস্থিতি নেই।
আদৌ আর কাজ করতে পারব কিনা জানি না, সারা দিন বাসায় থাকি। এ ঘর থেকে ও ঘরে
যাই লাঠিতে ভর করে। আমি ক্লান্ত।’
প্রবীর কুমার মিত্রের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৮ আগস্ট চাঁদপুরের নতুন বাজারে।
তাঁর পুরো নাম প্রবীর কুমার মিত্র। পৈতৃক নিবাস কেরানীগঞ্জের শাক্তায়।
পুরান ঢাকায় বড় হওয়া প্রবীর মিত্র স্কুলজীবন থেকেই নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত
হন। স্কুলজীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
১৯৬৯ সালে প্রয়াত এইচ আকবরের ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম প্রবীর
মিত্র ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। এই চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্য ও সংলাপকার
হিসেবে অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও চলচ্চিত্রটি
মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি। পরবর্তীতে পরিচালক এইচ আকবরের হাত ধরে
‘জলছবি’ নামে একটি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েছে বড়পর্দায় তাঁর অভিষেক হয়।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রবীর মিত্র ‘নায়ক’ হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রে
অভিনয় করেছেন। এরপর ‘চরিত্রাভিনেতা’ হিসেবে কাজ করেও তিনি পেয়েছেন
দর্শকপ্রিয়তা। তৎকালীন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘জীবন তৃষ্ণা, ‘সেয়ানা’,
‘জালিয়াত’, ‘ফরিয়াদ’, ‘রক্ত শপথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘জয় পরাজয়’, ‘অঙ্গার’,
‘মিন্টু আমার নাম’, ‘ফকির মজনু শাহ’, ‘মধুমিতা’, ‘অশান্ত ঢেউ’, ‘অলংকার’,
‘অনুরাগ’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘তরুলতা’, ‘গাঁয়ের ছেলে’, ‘পুত্রবধূ’, ‘বাঁধনহারা’,
‘মৌ চোর’, ‘সুখের সংসার’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘মান সম্মান’, ‘চেনা মুখ’,
‘অপমান’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘আশীর্বাদ’, ‘ফেরারি বসন্ত’, ‘আঁখি মিলন’, ‘নাজমা’,
‘হাসু আমার হাসু’, ‘প্রিন্সেস টিনা খান’,‘ তালাক’, ‘মান সম্মান’, ‘রসের
বাঈদানী’, ‘নয়নের আলো’, ‘সুরুজ মিঞা’, ‘দহন’, ‘মায়ের দাবি’,‘ দুলারি’,
‘অভাগী’, ‘নারী’, ‘শিরি ফরহাদ’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘চাষার মেয়ে’, ‘নবাব
সিরাজউদ্দৌলাহ’, ‘ঘর ভাঙা ঘর’, ‘বাল্যশিক্ষা’, ‘দুর্দান্ত দাপট’, ‘মৃত্যু
কত ভয়ংকর’, ‘ভণ্ড বাবা’, ‘রানী কেন ডাকাত’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘বেদেনীর প্রেম’,
আশা নিরাশা’, ‘ডাকু ও দরবেশ’, ‘নয়া তুফান’, থেকে শুরু করে একালের ‘বলো না
তুমি আমার’, ‘দেহরক্ষী’, ‘সুইটহার্ট’, ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসলেই
ঘর বাঁধা যায় না’ এর মতো ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়
করেছেন। অসুস্থ হওয়ার আগে প্রায় ৪০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
গত
১৮ আগস্ট অভিনেতা প্রবীর মিত্রের জন্মদিন ছিল। নিঃসঙ্গ একলা এই অভিনেতার
এখন সময় কাটে শুধু অতীতের ব্যস্ত সময়ের স্মৃতির কথা মনে করে। জাতীয়
চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই অভিনেতার ভাষায়, ‘বেশ কয়েক বছর হলো আমার
স্ত্রী বেঁচে নেই। তাঁর না থাকা এখন অনুভব করছি। কেমন জানি হয়ে গেছি। আজ
আমি বড় একা। কাজ করতে শরীর সায় দেয় না বলে মানুষ খোঁজ নেয় না। মাঝেমধ্যে
ভাবি, কাদের জন্য এত কাজ করেছি! শারীরিক সুস্থতার জন্য সবার কাছে আশীর্বাদ
চাওয়া ছাড়া আমার কিছু বলার নেই।’
জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর প্রবীর মিত্র কোনো টিভি চ্যানেলের মুখোমুখি হলেন
গতকাল বুধবার তাঁর বাসভবনে বসে। চ্যানেল আই এর ‘কিউট সাময়িকী’ অনুষ্ঠানে
তিনি কথা বলেছেন তাঁর অতীত-বর্তমান, সুখ-দুঃখ, নিঃসঙ্গ একাকী জীবনের নানা
প্রসঙ্গ নিয়ে। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সাংবাদিক আবদুর রহমানের সঞ্চালনায় এই
বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার হবে শুক্রবার ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ৬টায়।