এমনি এক বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরনী মাহবুব। বিজ্ঞাপনটি ছিলো- অস্ট্রেলিয়ার পড়ার সুযোগ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। আবার মিলবে থাকার সুবিধা ও মাস প্রতি মোটা অংকের অর্থ। এই বিজ্ঞাপনে পা দিয়ে তিনি খোয়ান ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
অরনী জানান, এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। তাদের দেয়া সময়মতো ফার্মগেইটের অফিসে যোগাযোগ করেন। অফিসে যাবার পর দেখেন সাজানো গোছানো ছোট একটি অফিস। একটি আবদ্ধ রুম আর সামনে ছোট ডেস্ক। রিসিপসনে বসা একজন তরুনী। তার কথা বেশ সাজানো গুছানো। যাবার সঙ্গেই চায়ের ব্যবস্থা। আর সঙ্গে দেখানো হয় তাদের মাধ্যমে বিদেশ গমন করেছেন কজন। কিভাবে গেছেন। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি ইত্যাদি। এরপর সুযোগ মেলে তার ভিতরে যাবার।
অরনী বলেন, আমি আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে সেখানে যাই। ভিতরে ছিলেন মিজানুর রহমান নামে একজন। তিনি আমাদের নানা বিষয় বুঝাচ্ছিলেন। এর ফাঁকে খুব কৌশলে জেনে নেন পারিবারিক অবস্থা। আরো জেনে নেন কোন বিষয়ে কোন দেশে যেতে আগ্রহী। কথা শেষে ফের রিসিপসনের সেই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
এরপর বলা হয় ১ হাজার টাকা দিয়ে ফরম পুরণের জন্য। আমি অবাক হই আমি শুধু গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। আমার সঙ্গে নিয়েছিলাম আমার বান্ধবীকে। কিন্তু সেও আমার সঙ্গে ১ হাজার টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করে।
এভাবে চলে গেলো ১০ দিনের মতো। তারা কারো সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেননি। এই সূবর্ণ সুযোগে অন্যকে ভাগ বসাতে চাননা তারা। ১০ দিন পর ফের ডাক পড়লো তাদের। এবার ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজ রাখা হলো তাদের সামনে। অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কানাডার একটি। প্রতিটিতেই বিনা মূল্যে পড়াশুনার পাশাপাশি ২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলবে নগদ অর্থ। আরেকটিতে পার্ট টাইম কাজের সুযোগ।
মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে এই ৩ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে ২০ জন করে ৬০ জন। আর তার প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পাঠাতে পারবেন ১০ জনকে।
এরজন্য কী করণীয়? মিজানুর বলেন, প্রথমে এপ্লাই করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সনদপত্রের ফটোকপি ও বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রমাণপত্র। এছাড়াও বললেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা। এটা থাকবে গ্যারান্টি হিসেবে। যা খরচ হবে না। এপ্লাই করতে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। আর সকল কাগজপত্র হাতে পাবার পর দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু কেন এই ৫০ হাজার টাকা? এই বিদেশ যাত্রার সুযোগগুলো আমরা প্রচারণায় কম আনি। অধিক প্রচারণা করলে লাইন লেগে যেতো। আমরা আপনাদের পাঠাবো এই বাবদ দিতে হবে এই টাকা।
এরপর অরনীর বান্ধবী সেখান থেকে সরে আসলেও অরনী পরিবারকে না জানিয়ে দেন ১০ হাজার টাকা। এরপর তিনি তাদের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করেন। তার কদিন পর ফের ডেকে পাঠানো হয় তাকে। এরপর তাকে বলা হয় তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। কাগজপত্র ও ব্যাংকের ব্যবস্থা করতে। বিকল্প ব্যাবস্থাও আছে তার। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু এর জন্য দিতে হবে ২ লাখ টাকা।
মার্চের ২ তারিখ তাকে ২ লাখ টাকা ব্যাংকের এবং তাদের ফি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে দেখা করতে বলেন। অরনী বাড়িতে জানান স্কলারশীপের বিষয়টি। তারাও খুশি হয়ে যায়। টাকাসহ বাবাকে নিয়ে দেখা করতে আসেন মার্চের ২ তারিখে। সেখানে টাকা জমা দেন তারা। আর ধরিয়ে দেন অনেক কাগজ। নিতে বলেন প্রস্তুতি।
মে’র ১৫ তারিখে ফ্লাইট। আর এপ্রিলের ৫ তারিখে ভিসা ও বিমানের টিকিট নিয়ে যেতে বলেন। আর বলেন সেদিন ৫ হাজার টাকা সঙ্গে রাখতে। আস্ট্রেলিয়ার এম্বাসিতে গিয়ে ফরম পূরণ করতে হবে। কিন্তু এপ্রিলের ৫ তারিখে গিয়ে মেলে সেখানে বসেছে রেস্টুরেন্ট। জানতে চাইলে বলেন, আগের যারা ভাড়া নিছিলো তারা চলে গেছে। আর আমার মতো অনেকেই এসেছিলেন খোঁজ নিতে। এরপর থেকে মেলেনি তাদের খোঁজ। বন্ধ মোবাইল নম্বর আর নেই ফেসবুক পেইজটিও।
অরনীর মতো অনেকেই বিদেশে পড়ার স্বপ্নে হারিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। দেশে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার নামে গড়ে উঠেছে এমন অনেক ভুইফোঁর প্রতিষ্ঠান। তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। ডিউক মাহমুদ। বাড়ি রংপুর। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর জাপান যাবার স্বপ্নে ছিলেন বিভোর। মেলে সেই সুযোগ। শিখেন জাপানি ভাষা। তিনি কয়েক ধাপে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়েছেন। পরে মোহাম্মদপুরের ৭ মসজিদ সড়কের সেই অফিসটি পান বন্ধ। আর আরিফুল ইসলামের গল্পটা আরো কষ্টের। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই ছেলেটি মালয়েশিয়া যাবার জন্য বাড়িতে বলেন। কিন্তু পরিবার থেকে রাজি হয় না। এরপর মায়ের কাছে ২ লাখ টাকার আবদার করলে তার বাবাকে না জানিয়ে সঞ্চয়ের টাকা দেন একটি প্রতিষ্ঠানকে। তাদের মতো বিদেশে যাওয়া হয়নি শরিফ হাসানের। তিনি খুইয়েছেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
দীর্ঘ দিন থেকে বৈধভাবে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কাজ করছে ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপ। এর চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার বলেন, উচ্চ শিক্ষায় বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে হতে হবে সচেতন। শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন দেখে বসে থাকলে হবে না। খোঁজ রাখতে হবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। তবেই সুষ্ঠ তথ্য নিশ্চিত হবে। এতে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না।