জানা গেছে, ২০০৫ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চাকরি হয় আনিসের। অফিসের পিয়নের কাজের পাশাপাশি কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন তিনি। এতে করে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি কার্যালয়ে আসা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও পরিচয়ের সুযোগ হয় তাঁর। কম্পিউটারে নিয়মিত সারা দেশের সব যুবলীগ কমিটির তালিকা তৈরি করতে গিয়ে সব তথ্য তাঁর নখদর্পণে চলে আসে। মুখস্থ বলে দিতে পারতেন যেকোনো কমিটির নেতার নাম। এসব কারণেই চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা প্রথম
আলোকে বলেন, ২০১২ সালে যুবলীগের নতুন কমিটি গঠনের সময় তিনি নিজেও আনিসকে
একটা সদস্যপদ দিতে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু আনিস পেয়ে যান উপ-দপ্তর
সম্পাদকের পদ। দপ্তর সম্পাদক পদটি শুরু থেকেই খালি ছিল, ছয় মাসের মধ্যেই
সেটাও পেয়ে যান।
যুবলীগের তিনজন নেতা জানান, আনিস থাকতেন টিকাটুলী এলাকায়।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়ার পর চেয়ারম্যানের কাছাকাছি থাকার জন্য
ধানমন্ডিতে ভাড়া বাসা খোঁজেন। কিন্তু ভাড়া না নিয়ে ১৫ নম্বর সড়কে প্রায়
আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনে নেন। এখানেই আছেন প্রায় সাড়ে তিন
বছর। গতকাল রোববার ওই বাড়িতে গেলে ফ্ল্যাট মালিকদের তালিকায় তাঁর নাম দেখা
যায়। নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, মালিক এখানে থাকেন না, ভাড়াটে থাকেন।
বর্তমানে রাজধানীর ধানমন্ডির ১০/এ সড়কের এক বাড়ির একটি
ফ্ল্যাটে থাকেন কাজী আনিস। গতকাল সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যুবলীগের
নেতা-কর্মীরা একের পর এক ভেতরে ঢুকছেন এবং বের হচ্ছেন। নিরাপত্তারক্ষীদের
সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফ্ল্যাটটি আনিসুর রহমানের নিজের। প্রতিদিন শত শত
মানুষ গাড়ি, মোটরসাইকেল নিয়ে তাঁর সঙ্গে এখানে দেখা করতে আসেন।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ভাবড়াসুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া
গ্রামের ফায়েকুজ্জামান (ফায়েক কাজী) কাজীর চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে কাজী
আনিসুর রহমান। ২০০১ সালে ঢাকায় এসে প্রথমে পোশাক তৈরির কারখানায় চাকরি
নেন। এরপর ২০০৫ সালে এলাকার এক নেতার মাধ্যমে চাকরি নেন যুবলীগের
কার্যালয়ে।
গতকাল গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ভাবড়াসুর ইউনিয়নের
বোয়ালিয়া গ্রামে আনিসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বড় আকারের লোহার গেট পার
হলেই সুন্দর লন। এক পাশে দৃষ্টিনন্দন পানির ফোয়ারা। আরেক পাশে গোলটেবিল ও
চেয়ার সাজানো। এরপর মূল তিনতলা বাড়ি, যার মূল ফটক বিভিন্ন পাথরে সাজানো।
তিনতলায় কাজ চলছে।
আনিসের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘আগে পাঁচ-ছয় বিঘা জমি ছিল।
গত ৪ বছরে আরও জমি কিনেছি। এই বাড়ি করেছি, পেট্রলপাম্প এবং তার পাশের জমি
কিনেছি।’ গ্রামের সবুর মোল্লা বলেন, ‘বাড়িতে ছিল একটা টিনের ঘর। চার বছরে
আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। মনে হয়, আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে।’
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মুকসুদপুর মা ফিলিং স্টেশনে কথা হয়
আনিসের বাবা ফায়েক কাজীর সঙ্গে। তিনি সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন, ১৯৯৪ সালে
অবসর নেন। ৭ লাখ টাকা পেয়ে কিছু জমি কেনেন। পরে কিছু বিক্রিও করে দেন। তবে
গত কয়েক বছরে জমি কেনা, পেট্রলপাম্প কেনার টাকার উৎস নিয়ে কিছু বলতে চাননি
তিনি। ৩৪ লাখ টাকায় ২০১৬ সালে পেট্রলপাম্প কেনেন বলে দাবি করেন।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন,
আনিস যুবলীগের পদ পাওয়ার পরই তাঁদের উত্থান শুরু। পেট্রলপাম্প প্রায় দেড়
কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন। পাশেই ৫ একর জায়গা আছে তাঁদের কেনা। এ ছাড়া ঢাকায়
আনিসের তিনটি বাড়িতেই তিনি গেছেন।
সম্পদের বিবরণী পেয়ে তাঁর অর্থের উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে
জানা গেছে, চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন ও যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে
পদ-বাণিজ্য করেই বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন কাজী আনিস। গত শনিবার ফেসবুকে একটি
পোস্ট দিয়েছেন যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সরদার মোহাম্মদ আলী ওরফে
মিন্টু। পোস্টটি শেয়ার করেন ২৮৯ জন। এর সূত্র ধরে গোপালগঞ্জের মোহাম্মদ
আলীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, কমিটি বাণিজ্য করে বিপুল
ধনসম্পদের মালিক হয়ে গেছেন আনিস। যুবলীগ চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে
এসব অপকর্ম করে যাচ্ছেন একসময়ের এই কম্পিউটার অপারেটর।
এসব অভিযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগ ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ
যুবলীগের সাতজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা সবাই অভিযোগের
সত্যতা নিশ্চিত করলেও কেউ নিজেদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। নেতারা আরও
অভিযোগ করেন, আনিসের বিরুদ্ধে কথা বলে টেকা কঠিন। বিভিন্ন ইউনিটে বছরের পর
বছর সম্মেলন না করে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চালানো হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে এসব
আহ্বায়ক কমিটি বানানো ও দীর্ঘদিন বহাল থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন আনিস।
আনিসের দাপটে পুরোনো অনেক নেতা যুবলীগে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন।
কৃষিজমিতে শিল্প করা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায়
বহিষ্কৃত হয়েছিলেন যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আতাউর রহমান। রাজধানী
সুপার মার্কেটে র্যাবের অভিযানে আটক হওয়ায় বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ঢাকা মহানগর
দক্ষিণ যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। প্রধানমন্ত্রীর
সঙ্গে নিজের ছবি কৃত্রিমভাবে জুড়ে দেওয়ায় (সুপার ইম্পোজিং) বহিষ্কৃত
হয়েছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদুর রহমান।
তাঁদের তিনজনের সঙ্গেই কথা বলেছে প্রথম আলো। পদ ফিরে পেতে তাঁদের ক্ষেত্রে
কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি বলে দাবি করেছেন তাঁরা। অভিযোগ যাচাই ও রাজনৈতিক
ক্যারিয়ার বিবেচনায় পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তাঁরা দাবি করেছেন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে কাজী আনিসুর রহমানের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায়
যোগাযোগ করা হলে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান প্রথম
আলোকে বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় বাসা থেকে বের হয়ে চেয়ারম্যান স্যারের অফিসে
গেছেন আনিস। তাঁকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে এসেছে। কিন্তু বেলা দুইটা থেকে ফোন
বন্ধ পাচ্ছেন। কোনো খবর পাচ্ছেন না।
যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে একাধিকবার চেষ্টা করেও
পাওয়া যায়নি। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ বলেন, কাজী আনিসের খোঁজ
নিতে তাঁকেও কয়েকজন ফোন করেছেন।