জাকির নায়েক একজন ভারতীয় ইসলাম প্রচারক। তার আবাসস্থল অবশ্য এখন মালয়েশিয়া।
ওয়াশিংটন পোস্ট তাকে ‘টেলিভিশনকেন্দ্রিক ধর্মপ্রচারের রক স্টার’ হিসেবে
আখ্যা দিয়েছে। তবে তিনি আবার পলাতকও। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে তিনি নিজ দেশ
ভারতের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে পলাতক। ওই সময় বাংলাদেশে ঘটে যায় এক
ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হামলা। পরে জানা যায়, হামলাকারীদের কেউ কেউ জাকির নায়েকের
ভিডিও থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। জাকির নায়েক সালাফি
ইসলামের সমর্থক। তার অনেক বক্তব্যই উস্কানিমূলক। তিনি দাবি করেছিলেন যে,
প্রত্যেক মুসলিমেরই সন্ত্রাসী হওয়া উচিত। এমনও বলেছিলেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রে
আত্মঘাতী বোমা হামলা অযৌক্তিক কিছু নয়। ধর্মত্যাগীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া
উচিত, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রার্থনালয় প্রতিষ্ঠা
করতে দেয়া উচিত নয় মর্মেও তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন।
তার টেলিভিশন
চ্যানেলের নাম ‘পিস টিভি’। এটি এখন ভারত, বাংলাদেশ ও ২০১৯ সালের ইস্টার
বোমা হামলার পর শ্রীলংকায় নিষিদ্ধ। শ্রীলংকা হামলার অভিযুক্ত মাস্টারমাইন্ড
জাহরান হাশিম নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে তিনি
নিজের অনুসারীদের আহ্বান জানান তারা যেন জাকির নায়েকের জন্য কিছু করেন।
২০১৬ সালে ভারতের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী আইনের অধীনে জাকির নায়েকের ‘ইসলামিক
রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ নিষিদ্ধ করা হয়। অভিযোগ ছিল, ওই প্রতিষ্ঠান ‘ওসামা বিন
লাদেনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার’ করছে। তাকে এ বছর অর্থ পাচারের অভিযোগে
অভিযুক্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলারের অবৈধ সম্পদ অর্জনের
অভিযোগও আনা হয়।
এশিয়ার অনেক দেশ জাকির নায়েককে সন্দেহের দৃষ্টিতে
দেখলেও, মালয়েশিয়ায় তিনি লাল গালিচা অভ্যর্থনা পেয়েছেন। সেখানে তাকে স্থায়ী
বাসিন্দার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে তিনি যেখানেই
বক্তৃতা দিতে গেছেন, লাখ লাখ মানুষ সেখানে সমবেত হয়েছে।
আগস্টের
শুরুতে কেলান্তান অঙ্গরাজ্যে এমনই এক বক্তৃতা প্রদানের সময়, জাকির নায়েক
মালয়েশিয়ার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিশেষ করে
চীনা-মালয়েশিয়ানদের তিনি ‘অতিথি’ হিসেবে সম্বোধন করেন, যারা কিনা দেশটিতে
উনিশ শতকের শুরু থেকে বসবাস করে আসছে। বর্তমানে চীনা মালয়েশিয়ানদের সংখ্যা
মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের
অনেক সংগঠন ও আইনপ্রণেতারা জাকির নায়েককে ভারতে ফিরে যেতে বলে আসছে। তখন
জাকির নায়েক তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তারা এখানে জন্মাননি। যদি আপনারা নয়া
অতিথিদের চলে যেতে বলেন, তাহলে পুরনো অতিথিদেরও চলে যেতে বলুন।’ শুধু চীনা
মালয়েশিয়ানরা নয়, হিন্দু ভারতীয় মালয়েশিয়ানদের নিয়েও তিনি কথা বলেন। তার
ভাষ্য, ভারতে মুসলিমরা যেই অধিকার পায়, তার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি অধিকার
মালয়েশিয়ায় হিন্দু নাগরিকরা ভোগ করে। তার ভাষ্য, ‘তারা এতটাই বেশি অধিকার
ভোগ করে যে, তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করে; মালয়েশিয়ার
প্রধানমন্ত্রীকে নয়।’ তবে জাকির নায়েক বলছেন, তার এই বক্তব্য ভুলভাবে
উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার রাজনীতিক ও পর্যবেক্ষকরা ব্যাপকভাবে
জাকির নায়েকের সমালোচনা করেছেন। তাকে ফেরত পাঠানোর দাবিতে এক পিটিশনে ১ লাখ
২০ হাজার মানুষ সই করেছে। মালয়েশিয়ার পুলিশ পরবর্তীতে তাকে প্রকাশ্যে
বক্তৃতা প্রদান থেকে নিষিদ্ধ করেছে। পুলিশের বক্তব্য, জাতীয় নিরাপত্তার
স্বার্থে ও জাতিগত সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে ওই সিদ্ধান্ত নেয়া
হয়েছে।
শাসক জোট পাকাতান হারাতানের অনেক নেতা মত দেন যে, জাকির
নায়েককে ফেরত পাঠানো উচিত। মালয়েশিয়ার ২৬ বছর বয়সী যুব মন্ত্রী ও
প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের মালয়েশিয়ান ইউনাইটেড ইন্ডিজেনাস পার্টির
যুব শাখার প্রধান সৈয়দ সাদিকও প্রথমে সেই কথাই বলেছিলেন। তিনি বলেন,
‘আমাদের চীনা ও ভারতীয় ভাই-বোনদের ওপর আক্রমণ মানে সকল মালয়েশিয়ানদের ওপরই
আক্রমণ। আমার সহ-নাগরিকরা আমাদের অতিথি, এমনটা ভাবতেও হাস্যকর লাগে। তারা
আমাদের পরিবার। যথেষ্ট হয়েছে।’
তবে এক সপ্তাহ পর সাদিক কিছুটা মত
পরিবর্তন করেন। জাকির নায়েককে বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি টুইট করেন,
কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আসুন সব ভুলে সামনে এগিয়ে যাই। তিনি আরো বলেন,
‘মালয়েশিয়া একটি বহুজাতির ও ধর্মের দেশ। চরমপন্থার চেয়েও মধ্যপন্থা হলো
আমাদের পথ। আমাদের ঐক্যই আমাদের শক্তি।’
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে
পরিচিত সাদিকের মতও গোটা মন্ত্রিসভার সাদৃশ্য। প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরও
বলেন, জাকির নায়েক দেশে ফিরলে তাকে হত্যা করা হতে পারে। তার ভাষ্য, ‘তিনি
আজকে এখানে আছেন। কিন্তু যদি অন্য কোনো দেশ তাকে নিতে চায়, আমরা স্বাগত
জানাবো।’
ওদিকে মাহাথিরের প্রতি লেখা এক খোলা চিঠিতে
ভারতীয়-মালয়েশিয়ান কলামিস্ট রবিন্দর সিং লিখেছেন, ‘জাকির নায়েক আজ
মালয়েশিয়ান ভারতীয় ও চীনাদের যে আক্রমণ করে কথা বললো, তা আপনারই অন্ধ
সিদ্ধান্তের সরাসরি ফল। আপনি কোনো অবস্থাতেই তাকে ফেরত পাঠাবেন না।’
এদিকে
দিল্লিতে গত সপ্তাহে ইন্টারপোলের সেক্রেটারি জেনারেল জুর্গেন স্টক সফর
করলে, ভারতীয় কর্মকর্তারা তাকে অনুরোধ করেন জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে রেড
নোটিশ জারি করা হোক। তবে জাকির সম্প্রতি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাকে
চায়। কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী চান না আমার প্রতি কোনো অবিচার
হোক।’ ১০ই আগস্ট কেলান্তানিজ অঙ্গরাজ্যের কোতা বাহরুতে ১ লাখ মানুষের এক
সমাবেশে তিনি বলেন, সারাবিশ্বের মুসলমানদের স্বার্থ দেখছেন মাহাথির।
গত
সপ্তাহে মালয়েশিয়া তুরস্কের এক পরিবারকে জোর করে ফেরত পাঠিয়েছে। এই
সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা। তারা বলেছে, এটি
আন্তর্জাতিক আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘন। অনেক সমালোচকই তখন এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে
জাকির নায়েককে রেখে দেয়ার তুলনা করেন।
বর্তমানে মালয়েশিয়ায় ১ লাখ
৬০ হাজার আশ্রয় প্রত্যাশী ও শরণার্থী বসবাস করেন। এরা জাকিরের মতন স্থায়ী
বাসিন্দার মর্যাদা ভোগ করেন না। তবে এই দ্বিচারী ভূমিকার অভিযোগ উড়িয়ে
দিয়েছেন মাহাথির।
অনেকে মনে করেন, মালয়েশিয়ায় জাকির নায়েকের উপস্থিতির
ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পরোক্ষ সমর্থন ‘প্যাক্ট অব হোপ’-এর পরিপন্থী। এই
চুক্তি মোতাবেকই সরকার প্রগতিশীল মূল্যবোধ ও বহুত্ববাদের প্রতি অঙ্গীকার
ব্যক্ত করেছে। এই চুক্তিই ছিল তাদের ম্যান্ডেট, যার ভিত্তিতে তারা
নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এর মধ্য দিয়ে উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক ইসলামের শক্তিও
টের পাওয়া যায়। এই ‘নতুন মালয়েশিয়া’র নববেগবান গণতন্ত্রেও
মালায়-আধিপত্যবাদী বিদ্যমান ব্যবস্থাই টিকে রইলো।
(এই নিবন্ধ লো ইন্টারপ্রেটার থেকে নেয়া হয়েছে।)