যাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিয়মিত শোধ করছেন, নতুন কিছু
উৎপাদন করছেন, এমন ভালো গ্রাহকদের কয়েক মাস ধরেই খুঁজছিলাম। সেই খোঁজার অংশ
হিসেবে যোগাযোগ করেছিলাম শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে। ব্যাংকটির
ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শহীদুল ইসলাম ১৮ মিনিটের মধ্যেই খোঁজ দিলেন সৈয়দ
নাসিরের। আর বললেন, ‘এমন গ্রাহককে অর্থায়ন করে আমাদের ব্যাংক গর্বিত। তাঁর
কারখানার কর্মীদের বেতন তোলার জন্য আমরা এটিএম বুথও বসিয়েছি।’
সৈয়দ নাসিরের গল্প শুনতে গত বুধবার গিয়েছিলাম টঙ্গীতে তাঁর
কারখানায়। প্রতিষ্ঠানের নাম কিউ পেইল লিমিটেড, যেটি টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরে
অবস্থিত। চট্টগ্রামে এক্সক্লুসিভ ক্যান নামে আরেকটি কারখানা রয়েছে।
কারখানার ফটকেই সৈয়দ নাসিরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। পুরো কারখানা ঘুরে ঘুরে
দেখালেন। আমদানি করা পলিথিলিন থেকে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছোট-বড়
ক্যান। ৫৪ হাজার বর্গফুট এলাকার পুরো কারখানায় হাতের কোনো ছোঁয়া নেই,
উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াই হচ্ছে রোবটে। উৎপাদিত ক্যান চলে যাচ্ছে পেইন্টিং
বিভাগে। ১৫ হাজার বর্গফুট এলাকায় তৈরি ক্যানে বসছে চাহিদামতো বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানের রং ও স্টিকার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রঙের ছোট-বড় ক্যান,
আইসক্রিমের বক্স, মবিলের ক্যান, ওষুধের বোতল—সবই তৈরি হচ্ছে তার কারখানায়।
আগে এসব পণ্য আসত বিদেশ থেকে। এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। সৈয়দ নাসির বললেন,
‘কারখানায় ৬০০ কর্মী কাজ করেন। সবাই আমার পরিবারের সদস্য। কর্মীদের বিপদে
আমি নিজেই এগিয়ে যাই। তাঁরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।’
চাকরি খোঁজার উদ্দেশে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিলেন
সৈয়দ নাসির। ট্রেনেই পরিচয় হয় বার্জারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রেজাউল করিমের
সঙ্গে। তিনি চাকরির পরিবর্তে ব্যবসার পরামর্শ দিলেন সৈয়দ নাসিরকে। রঙের
ক্যান তৈরি করতে বললেন। চট্টগ্রামে ফিরে বার্জার অফিসে দেখা করতে গেলে
রেজাউল করিম তাঁকে নিয়ে গেলেন সরকারের মালিকানাধীন বাংলাদেশ ক্যান
কোম্পানিতে। যাঁরা ওই সময়ে টিনের ক্যান তৈরি করে বার্জারকে সরবরাহ করত।
কারখানাটি ছিল আধুনিক ও ব্যয়বহুল। এরপর গেলেন এলিট পেইন্টে। এলিট থেকে এক
কর্মীকে নিয়ে এলেন। তারপর বাবার দেওয়া ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ছোট আকারে
কারখানা করলেন চট্টগ্রামের মুরাদপুরে। ১৯৯২ সালে টিনের ক্যান তৈরি করে
বার্জারকে দেওয়া শুরু করেন। এ নিয়ে সৈয়দ নাসির বলেন, ‘বাবার অবসরের টাকাই
ছিল আমার ব্যবসার প্রথম মূলধন।’
ব্যবসায় মোড় ঘুরিয়ে দেয় ব্যাংক
কারখানা দেওয়ার পর ঋণের জন্য সৈয়দ নাসির যোগাযোগ করেন সোনালী
ব্যাংকের পাঁচলাইশ শাখায়। ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি লুৎফর রহমান সরকার তখন
সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এ কারণে সহজেই
সোনালী ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়ে যান। আরও ১৫ লাখ টাকা পান প্লেজ
(গুদামজাত পণ্যের বিপরীতে দেওয়া ঋণ) ঋণ হিসেবে। সৈয়দ নাসির বলেন,
‘সার্টিফিকেট বন্ধক রেখে ঋণপ্রথা চালু ছিল যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এমন
শতাধিক শিল্পপতি পাওয়া যাবে, যাঁরা ওই ঋণসুবিধা নিয়ে বড় হয়েছেন।’
১৯৯৬ সালে ভারতে যান টিনের ক্যান তৈরির আধুনিক প্রযুক্তি
দেখতে। ১৯৯৯ সালে ৫৫ লাখ টাকা ঋণ পান সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে। ওই টাকায়
কারখানার পাশে ৪ তলা ভবন কিনে নেন। সৈয়দ নাসির বলেন, ‘এ ঋণই আমার জীবনের
মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কারখানা বড় হয়ে যায়।’ ক্যানের নির্দিষ্ট ক্রেতা বার্জার,
ফলে কোনো চিন্তাই ছিল না।’
তবে ওই সময়ে বার্জার পেইন্ট নিজেরাই ক্যান বানানোর সিদ্ধান্ত
নেয়। এতে বড় হোঁচট খান সৈয়দ নাসির, কারণ বার্জারই ছিল তাঁর পণ্যের একমাত্র
ক্রেতা। পরে অন্য রং কোম্পানিতে ক্যান দেওয়া শুরু করেন। তখন সব কোম্পানির
প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে।
ঢাকায় কারখানা স্থাপন
২০০০ সালের দিকে রোমানা রং ঢাকা থেকে কার্যক্রম শুরু করে।
রোমানার বাহার নামে বিজ্ঞাপন এনে তারা ঢাকার বাজারও পায়। তার আগে সব রং
কারখানার প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামে। ঢাকার বাজার ধরতে বার্জারও
সাভারে কারখানা করে। এবার বার্জারের পরামর্শে সৈয়দ নাসির ঢাকার সাভারে
কারখানা করেন।
সৈয়দ নাসির বলেন, ‘আড়াই বছর চুক্তি শেষে বার্জার আর টিনের ক্যান নিতে চাইল না। তারা প্লাস্টিকের ক্যান তৈরি করতে বলল। বড় বিনিয়োগ, আমি পারলাম না। কারখানা বন্ধ করে ফিরে গেলাম চট্টগ্রামে। কিছুদিনের মধ্যে বুঝলাম, আমি হেরে গেলাম।’
বছরখানেকের মধ্যে আবারও ঢাকায় ফিরলেন। পুরান ঢাকার আল রাজ্জাক হোটেলে উঠলেন। শিখলেন প্লাস্টিকের ক্যান বানানো। এবার চট্টগ্রামে ফিরে প্লাস্টিকের ক্যান বানানো শুরু করলেন, সরবরাহ করলেন মুনস্টার রং কোম্পানিতে। এবার বার্জারও তার থেকে প্লাস্টিকের ক্যান নিতে শুরু করল, তা শুধু চট্টগ্রামের জন্য।
সৈয়দ নাসির বলেন, ‘আড়াই বছর চুক্তি শেষে বার্জার আর টিনের ক্যান নিতে চাইল না। তারা প্লাস্টিকের ক্যান তৈরি করতে বলল। বড় বিনিয়োগ, আমি পারলাম না। কারখানা বন্ধ করে ফিরে গেলাম চট্টগ্রামে। কিছুদিনের মধ্যে বুঝলাম, আমি হেরে গেলাম।’
বছরখানেকের মধ্যে আবারও ঢাকায় ফিরলেন। পুরান ঢাকার আল রাজ্জাক হোটেলে উঠলেন। শিখলেন প্লাস্টিকের ক্যান বানানো। এবার চট্টগ্রামে ফিরে প্লাস্টিকের ক্যান বানানো শুরু করলেন, সরবরাহ করলেন মুনস্টার রং কোম্পানিতে। এবার বার্জারও তার থেকে প্লাস্টিকের ক্যান নিতে শুরু করল, তা শুধু চট্টগ্রামের জন্য।
২০০৩ সালে ঢাকায় এশিয়ান পেইন্ট চালু হলো। ওই সময়ে অনেক
কোম্পানি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসে। ২০০৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায়
আসেন। এশিয়ান পেইন্টকে ক্যান দিতে টঙ্গী ব্রিজের কাছে কারখানা চালু করেন।
২০১০ সালে কারখানা স্থানান্তর করেন টঙ্গীর বিসিকে। এরপর সব রং কোম্পানি তার
গ্রাহক হয়ে যায়। ওই সময়ে বৈশ্বিক রং উৎপাদক প্রতিষ্ঠান জটুন, নিপ্পন ও
একজোনোবেল দেশে আসে। সৈয়দ নাসিরের মতে, ‘এতে আমার পণ্যের বাজার আরও বড় হয়।
ওই সময় ওষুধ কোম্পানিগুলো আমাদের পণ্য নেওয়া শুরু করে।’
এখন টঙ্গী বিসিকের পাশেই নতুন কারখানা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
পাঁচতলায় ১ লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা। নির্মাণ শেষ পর্যায়ে, অক্টোবরেই
চালু হবে। এটি নির্মাণ হচ্ছে সবুজ কারখানার সব শর্ত মেনে।
ব্যবসা ও গ্রাহক
সৈয়দ নাসিরের ব্যবসা অন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তার
প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় প্লাস্টিক ও টিনের ক্যান। এসব ক্যানে পেইন্ট ও
স্টিকারও বসানো হয়। ঢাকার টঙ্গী ও চট্টগ্রামের মুরাদপুরে তাঁর কারখানা। রং
উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোই তার বড় ত্রেতা। এর মধ্যে অন্যতম হলো বার্জার,
এশিয়ান পেইন্ট, নিপ্পন পেইন্ট, আর এ কে পেইন্ট, উজালা পেইন্ট, রেইনবো,
একজোনোবেল, জটুন, ফেবিকল, এলিট পেইন্ট, মুনস্টার পেইন্ট। খাদ্য প্রস্তুত
প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোয়ালিটি আইসক্রিম, মিল্ক ভিটা, ওয়েল ফুড, আড়ং দুধ,
এসিআই, ব্লুপ ও পোলার আইসক্রিমকে কনটেইনার সরবরাহ করেন তিনি। এর বাইরে ওষুধ
খাতের রেডিয়েন্ট ফার্মা ও পপুলার ফার্মাকেও কিছু ওষুধের কনটেইনার দেন সৈয়দ
নাসির।
শাহজালাল ইসলামী, ব্র্যাক ও ইউনাইটেড ফাইন্যান্সের ঋণে চলে
তাঁর ব্যবসা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৫ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে
প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিক্রি বেড়ে হয় ১১৪ কোটি টাকা।
ঢাকায় কারখানায় শ্রমিক রয়েছেন ৬০০, চট্টগ্রামে ২০০। টঙ্গীর
কারখানায় কর্মীদের বেতন হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। তাঁদের জন্য কারখানার ভেতরেই
রয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথ। সৈয়দ নাসির বলেন, ‘বেসরকারি
ব্যাংক ব্যবসায়ীদের আশীর্বাদ। এসব ব্যাংক না হলে এত ব্যবসায়ী কখনোই তৈরি
হতো না। আমার ক্ষেত্রেও তা–ই।’
তবে শেষ করেন এই বলে, ‘প্লাস্টিকের পণ্য তৈরি করছি। ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছি, এটা সব সময় আমাকে ভাবায়। কারণ এসব
প্লাস্টিক তো কখনোই পচবে না।’