শিল্পপতির সুন্দরী কন্যা। আমেরিকান সিটিজেন। বয়স ৩৫। লম্বা ৫ ফুট ৪
ইঞ্চি। বিধবা। মা সচিব। ঢাকায় গাড়ির শোরুম ও দামি বিপণিবিতানে দোকান রয়েছে।
গ্রামের বাড়ি খুলনা। ছুটিতে এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার জন্য
ধার্মিক-নামাজি পাত্র চাই। পত্রিকায় এমন একটি বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ আটকে যায়
আকরামের। তার ভাগ্নের জন্য খারাপ হবে না। ভাবছেন তিনি। বিদেশে থাকতে
থাকতেই বিয়ের বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল। দেশে ফিরে যাও বিয়ে করল তাও টেকেনি।
ভাগ্নে আর বিয়ে করবে না বলেও মনস্থির করে বিদেশে চলে যায়। আবারও দেশে
ফিরেছে। পরিবারের সবাই তাকে নিয়ে চিন্তিত। তার টাকা-পয়সা কী হবে। ভবিষ্যতেও
বা চলবে কীভাবে। যে কারণে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। এখন সে রাজি। সেই
ভাগ্নে সুলতানের জন্য মেয়ের খোঁজ করতে গিয়ে পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখছিলেন
আকরাম। পেয়েও গেলেন তিনি। বিজ্ঞাপনে পাত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে দেওয়া ফোন
নম্বরে কল করেন আকরাম। কিন্তু কলে সাড়া পান না। কয়েক দিন চেষ্টার পর আকরাম
ফোনে পান একজনকে। কথা বলতে বলতে বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনায় চলে আসেন তারা।
আকরামের কথা বলে ভালো লেগেছে। নম্বরটি সুলতানকে দেন। সুলতান ফোন করেন।
পাত্রীর চাচা পরিচয়ে একজন ফোন ধরেন। তাদের মধ্যেও কথা হয়। পাত্রীর নাম
হীরা। সুলতানের সঙ্গে কথা বলেন ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণে। গল্প করেন নিউইয়র্ক,
নিউজার্সিসহ আমেরিকার বিভিন্ন শহরের। তাকে বিয়ে করতে সুলতানের আগ্রহের
কমতি নেই। বিশ্বের প্রভাবশালী, ধনী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও পাত্রীকে পেতে
আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন সুলতান। ইতিমধ্যে ছবিও দেখেছেন ইনবক্সে। সুন্দরী
পাত্রী। সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন তাকেই বিয়ে করবেন তিনি। হীরা আগেভাগেই
জানিয়ে দেয় তাকে, যদি পছন্দ হয় বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে। আর তাহলে দুজনে
মিলে বিয়ের মার্কেটিং করবে। পছন্দ করে তারা সব কিনবে। সুলতান তাতে রাজি।
তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলতে থাকে। এক সময় দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন পড়ে।
ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টেই তাদের দেখার সব আয়োজন করা হয়। যথা সময়ে সবাই
সেখানে হাজির। মেয়েকে দেখে পছন্দ হয় সুলতানের। সুলতান তাকে একান্তে কথা
বলতে চায়। আত্মীয়স্বজনদের এক টেবিলে রেখে আরেক টেবিলে গিয়ে দুজনে কথা বলেন।
তারা দুজনকে পছন্দ করেছে। বিয়ের তারিখ ঠিক করা হলো। এখন বিয়ের
মার্কেটিংয়ের কথাবার্তা চলছে। হীরা তাকে জানায়, বিয়েতে সে ১০ লাখ টাকা খরচ
করবে। সুলতানকে ৫ লাখ করলেই চলবে বলে হীরা তাকে জানায়। পাশাপাশি জিজ্ঞেস
করে, কত টাকা সে এনেছে মার্কেটিংয়ের জন্য। সুলতান জানায়, আমি দুই লাখ সঙ্গে
এনেছি। শুনে মন খারাপ করে হীরা। বলে, তুমি ৫ লাখ কেন আনোনি। এখনই তাহলে
মার্কেটিং করতাম। সুলতান বলে, ঠিক আছে। সেটা কাল হবে। অসুবিধা নেই। হীরা
তখন তার চাচাকে কাছে ডাকে। অন্য টেবিল থেকে তার চাচা এসে হীরাদের টেবিলে
এসে বসে। হীরা চাচাকে বলে, সে সুলতানকেই বিয়ে করব। ও এখন ২ লাখ টাকা এনেছে।
সেটা তোমার কাছে রাখ। বাকি ৩ লাখ কাল নিয়ে এলে একসঙ্গে মার্কেটিং করা
যাবে। হীরার এমন কথায় সুলতান কিছুই বলতে পারছিল না। সুলতান তার ব্যাগ থেকে
টাকা বের করে তাদের কাছে তুলে দেয়। রেস্টুরেন্টে বিল মিটিয়ে তারা চলে যায়।
পর দিন একই রেস্টুরেন্টে আসার কথা থাকলেও হীরা বা কেউ আর আসেনি। তাদের
দেওয়া ঠিকানায় গিয়েও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুলতান বুঝতে পারে তারা
প্রতারণার শিকার হয়েছেন। একটি জাতীয় দৈনিকে শাহানাকে আমেরিকান সিটিজেন
পাত্রী সাজিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নম্বরে কল দিলে
পাত্রীর মামা পরিচয়ে মাহবুব নামে এক ব্যক্তি কথা বলে। আস্থা অর্জন করতে
ব্যস্ততা দেখায় মাহবুব। জানায়, সে বরিশালে আছে পারিবারিক কাজে। এ বিষয়ে পরে
কথা বলবে। পরবর্তীতে ফোনে যোগাযোগ হলে মাহবুব ওই পাত্রকে দেখা করতে বলে।
মিরপুর-১০ নম্বরের ডায়াবেটিক হাসপাতালের রিসিপশনে দেখা হয় পাত্রীর স্বজন
পরিচয় দেওয়া মাহবুব ও রাজুর সঙ্গে। এ সময় পাত্রের পাসপোর্ট আছে কি-না জানতে
চায় তারা। পাসপোর্ট নেই জানার পর হতাশা প্রকাশ করে। তাৎক্ষণিকভাবে নিজেরাই
মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নেয়। দ্রুত পাসপোর্ট করার জন্য ৫
হাজার টাকা নেয় তারা। শুরুটা এভাবেই। পর দিন জানানো হয় শুভ সংবাদ। মোবাইল
ফোনে ধারণ করা ছবি দেখেই পাত্রকে পছন্দ করেছে পাত্রী শাহানা। এবার শাহানার
কল। শুরু হয় আলাপচারিতা। অল্পতেই পাত্রকে প্রেমে মজাতে চেষ্টার কমতি নেই
শাহানার। ফোনে আলাপ শুধু শাহানার সঙ্গে নয়। কথা হয় পাত্রীর মা পরিচয়ে ফরিদা
বেগমের সঙ্গেও। বিয়ে করেই দেশ থেকে পাত্রকে নিয়ে যাবে শাহানা। বিয়ের পর
এভাবে দূরে থাকা যাবে না মোটেও। তাই দ্রুত বিয়ের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়
পাত্রকে। এমনকি প্রথম দেখাতেই যেন তাকে আংটি পরানো হয় এরকম ইচ্ছার কথা
প্রকাশ করে শাহানা। শাহানার মা পরিচয়ে ফরিদা জানায়, ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে
দেওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু সময় কম। তাই সেভাবে না হলে বিয়েতে খরচের কোনো
কমতি হবে না। বাকিটা শাহানা নিজেই পাত্রকে বলে, বিয়েতে আমি ১০ লাখ টাকা
খরচ করব। আপনি ৫ লাখ টাকা খরচ করবেন। এত টাকার অঙ্ক শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে
যান মধ্যবিত্ত পরিবারের ওই পাত্র। তিনি জানান, ২ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন।
পাত্রী শাহানা তা মেনে নেয়। কিন্তু ওই দুই লাখ টাকাও ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে
যায় পাত্রের কাছে। তাই বেশ কিছু দিন যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি। কিন্তু
অবাক করে দিয়ে পাত্রীর স্বজন পরিচয়দানকারীরাই যোগাযোগ করে। পাত্রকে দেখা
করতে বলে। আমেরিকান সিটিজেন পাত্রীর স্বজনদের এরকম আগ্রহ দেখে সন্দেহ
সৃষ্টি হয় ওই পাত্রের। এর আগেও এ রকম প্রতারণার সংবাদ পড়েছেন পত্রিকায়। তাই
বিষয়টি র্যাবকে জানান। র্যাব-১ এর পরামর্শে মিরপুর-৬ এর চার নম্বর সড়কের
২/এ নম্বর বাড়ির সামনে দেখা করতে যান ওই পাত্র। আশপাশে অবস্থান নেন র্যাব
সদস্যরা। ওই সময়ে গ্রেফতার করা হয় প্রতারক চক্রের চার সদস্যকে। র্যাব
কর্মকর্তারা বলেন, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এভাবে প্রতারণা করে আসছে। অনেক
ক্ষেত্রে পাত্রকে পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট করা ফ্ল্যাটে বা বাসায় নিয়ে
প্রলোভনে ফেলে দেয়। পাত্রী পরিচয়দানকারী ওই তরুণী ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে।
একপর্যায়ে কৌশলে কথিত পাত্রীর সঙ্গে একান্ত কিছু মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিও
ধারণ করে চক্রের সদস্যরা। তারপর এসব ছবি, ভিডিও ফুটেজ দিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং
করে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এ চক্রে আরও ১০-১২ জন জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে
রয়েছে ভুয়া কাজি খুলনার ফুলতলা থানার বুড়িয়ার গ্রামের শেখ হাফিজুর রহমান।
গ্রেফতারকৃতদের ফ্ল্যাট থেকে নোটারি পাবলিকের সব ধরনের সিল, জাল ফরম, ভুয়া
কাবিননামা জব্দ করা হয়েছে। র্যাব কর্মকর্তারা বলেন, বিজ্ঞাপন দেখেই এ
ধরনের কারও সঙ্গে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। বিজ্ঞাপন
দেখলেও তাদের সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
অন্যথায় এমন প্রতারণার জালে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে হবে।