অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান
অনুযায়ী আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা ৫০
পয়সা। কিন্তু বাস্তবে আরো ১ থেকে ২ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। হঠাৎ করে
খোলাবাজারেও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতি ডলার কিনতে সাধারণ গ্রাহকের ব্যয়
করতে হচ্ছে সাড়ে ৮৬ থেকে ৮৭ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, যারা ভ্রমণ
করতে বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৭ টাকা দরে। এক মাস আগেও
খোলাবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা। এক মাসের
ব্যবধানে তা বেড়েছে প্রায় দেড় টাকা।
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি অনেক বড় আমদানির দায় পরিশোধ হচ্ছে। এ কারণে অনেককে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে।
তবে খোলাবাজারে সরবরাহ তেমন নেই। এতে দাম বেড়ে গেছে। এছাড়া,
আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য না থাকা, বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা কারণে ডলারের
বাজারে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে রপ্তানি বাণিজ্য ও প্রবাসী আয় বা
রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে কিছুটা উৎসাহিত হলেও বেড়ে যাচ্ছে পণ্য আমদানির
ব্যয়। কারণ আমদানির জন্য বেশি মূল্যে ডলার কিনতে হচ্ছে। ফলে খাদ্যশস্য,
ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামালসহ সব আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়ছে।
সর্বপরি মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও জোগানের মধ্যে পার্থক্য বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কট বেড়ে
যাচ্ছে। এদিকে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধা দিতে সামনে ব্যাংকিং
চ্যানেলেও ডলারের দাম বাড়ানোর দাবি উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র
জানিয়েছে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার লেনদেনের ওপর
সীমা বেঁধে দিলেও সেটা প্রকৃতপক্ষে কার্যকর হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের
কাছে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের যে মূল্যের তথ্য দিচ্ছে
বাস্তবে তার চেয়ে বেশি মূল্যে কেনাবেচা হচ্ছে। অনেক ব্যাংক বাধ্য হয়ে
নীতিমালার ফাঁকফোকর দিয়ে বেশি দরে লেনদেন করছে।
এদিকে কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের বিভিন্ন ব্যাংক, খোলাবাজার ও মানি চেঞ্জারের লেনদেন পর্যবেক্ষণেও
ডলারের দর বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পুরো জুলাই মাসে
প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৩০ পয়সা দরে বিক্রি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা
পর্যন্ত হয়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কোনো কোনো দিনে প্রতি ডলার ৮৭ টাকায়ও
বিক্রি করে মানি চেঞ্জারগুলো। আমদানি চাপ থাকায় হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে
গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রতি মাসেই এলএনজি আমদানির
জন্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১ কোটি ডলার। আর বিপিসির দায় বাবদ প্রতি মাসেই
পরিশোধ করতে হচ্ছে ২৫ কোটি ডলার। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার
চাহিদা বেড়ে গেছে। সামনে এ চাহিদা আরো বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও
জোগানের মধ্যে পার্থক্য বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সামনে বেড়ে
যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ডলারের দর কার্যকর করছে না ব্যাংকগুলো।
কারণ
হিসেবে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও আর আগের মতো ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার
বিক্রি করছে না। ফলে পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করতে বাজার থেকে হয় তাদের
ডলার কিনতে হচ্ছে। অথবা একটি নির্ধারিত কমিশনের বিপরীতে ধার নিতে হচ্ছে। আর
এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংক। তারা ইচ্ছামাফিক ডলার মূল্য
আদায় করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া মূল্য ধরেই ফরওয়ার্ড
ডিলিং করছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। ফরওয়ার্ড ডিলিং হলো- একটি ব্যাংকের
পণ্যের আমদানি দায় মেটাতে ১০ কোটি ডলারের প্রয়োজন। চাহিদার দিনের ৪ থেকে ৫
দিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেয়া মূল্য ধরে ডলার কেনা হলো। এর সঙ্গে
বিনিময় ঝুঁকি বা অতিরিক্ত প্রিমিয়াম যুক্ত হচ্ছে। যেমন- ৪ দিন আগে ৮৪ টাকা
৫০ পয়সা দরে ডলার কেনা হলো। লেনদেনের দিন ২ শতাংশ অতিরিক্ত ধরে অর্থাৎ ৮৬
টাকায় ডলার লেনদেন করছে। এভাবেই বাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেয়া দর
কার্যকর করা হচ্ছে না।
এদিকে খোলাবাজারেও ডলারের মূল্য অস্থির হয়ে
পড়েছে। কারণ হিসেবে একজন মানিচেঞ্জার ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ক্যাসিনো,
টেন্ডারবাজিসহ চলমান অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের কারণেই
অনেকে আর নগদ টাকা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। এতে অনেকেই বাজার থেকে
ডলার কিনছেন। আবার অনেকেই বিদেশে যাচ্ছেন। এতে খোলাবাজারে হঠাৎ করে ডলারের
চাহিদা বেড়ে গেছে। নগদ ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজারে দাম মাত্র দুই
সপ্তাহের ব্যবধানে ২ টাকা বেড়ে গেছে। গত দুই সপ্তাহ আগেও প্রতি ডলার
বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। বর্তমানে তা ৮৭ টাকার উপরে বিক্রি করেছেন কোনো কোনো
মানিচেঞ্জার। এভাবেই খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে।
ব্যাংক
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংকের বাইরে বড় অঙ্কের টাকা মজুত রয়েছে।
সামপ্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে ঘিরে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তাতে
একটি গোষ্ঠীর মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আবার অনেকে দেশে
থাকলেও টাকা পরিবর্তন করে ডলার করে রাখছেন। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ লোকই
খোলাবাজার থেকে ডলার কিনছেন। কারণ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে গেলে তার জন্য
নানা কাগজপত্র লাগে। কিন্তু খোলাবাজার থেকে সহজে টাকা দিয়ে ডলার কেনা যায়। এ
পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বাড়লেও সে অনুযায়ী সরবরাহ নেই। এ
কারণেই চাপ বেড়ে গেছে।
ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২ অক্টোবর
আমদানি দায় মেটাতে ব্যবসায়ীদের থেকে দেশি ও বিদেশি খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক
৮৪ টাকা ৫০ পয়সা নিয়েছে। তবে একটি ব্যাংক আমদানি দায় মেটাতে ডলারের মূল্য
নিয়েছে ৮৪ টাকা ৭৫ পয়সা। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত মুদ্রা বিনিময় হার
অনুযায়ী, ২ অক্টোবর রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক নগদ
ডলার বিক্রি করেছে ৮৭ টাকা। একই দিন ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি
করেছে বিদেশি ব্যাংক আল ফালাহ। ৮৬ টাকা ৬০ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে
জনতা, বিডিবিএল, অগ্রণী ও এনসিসি ব্যাংক।
পরিস্থিতি অস্থিতিশীল
হওয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার কারসাজিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার
উদ্যোগ নিলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এ
বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ডলারের মূল্য দিয়েছে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। এখন ব্যাংকগুলো যদি ৮৭ টাকায় নগদ
ডলার বিক্রি করে তাহলে এটা অনেক বেশি। যেসব ব্যাংক ডলারের দাম বেশি নিচ্ছে
এটা কেন নিচ্ছে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখা উচিত। কারণ এর প্রভাবে যেন
ডলারের বাজার অস্থির না হয় এজন্য আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি
বলেন, ডলারের দাম বাড়লে দ্বিমুখী প্রভাব পড়ে। যেমন- দাম বাড়লে
রপ্তানিকারকরা লাভবান হয়। তবে সমস্যায় পড়ে আমদানিকারকরা। কারণ আমদানি ব্যয়
বাড়লে স্থানীয় বাজারের পণ্যের দাম বেড়ে যায়। চাপ পড়ে মূল্যষ্ফীতির উপর। এতে
করে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে সবচেয়ে কষ্ট হয় গরীবের।
বিদেশগামী
তামিম সরকার বলেন, এত দামে আগে কখনো তিনি ডলার কেনেননি। আগে সর্বোচ্চ
প্রতি ডলারের জন্য ৮৬ টাকা দিয়েছেন। আর এখন মতিঝিলের আশা মানি চেঞ্জার থেকে
৮৭ টাকা দরে ডলার কিনেছেন।