প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
পরিচালনায় চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া সংঘবদ্ধ,
বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক অঞ্চল হিসেবে পারস্পরিক বৈশ্বিক কল্যাণে
অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী আজ শুক্রবার নয়াদিল্লির হোটেল তাজ প্যালেসে ওয়ার্ল্ড
ইকোনমিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটের সমাপনী অধিবেশনে প্রস্তাব
(চিন্তাভাবনা) দিয়ে বলেন, ‘বিগত দশকগুলোতে আমরা অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী
চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগ দেখেছি। এর কিছু সফল হয়েছে, অন্যগুলো বাস্তবতায়
আসেনি। আমার দৃষ্টিতে আগামী দশকগুলোর জন্য নিম্নোক্ত চিন্তাভাবনা অনুসরণ
করা প্রয়োজন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রথমত, আমাদের সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য
শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সৌহার্দ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়াস চালিয়ে যেতে
হবে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যুগ
যুগ ধরে বহুত্ববাদ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি। এর মাধ্যমে আমরা ধর্ম, জাতি ও
ভাষাগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্র্যের উদ্যাপন করতে পারি। এটি হচ্ছে
মৌলিক বিষয়।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দ্রুত প্রবৃদ্ধির সময়ে সমাজে
যেন বৈষম্য আরও বেড়ে না যায়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সম্পদ হতে হবে
অন্তর্ভুক্তমূলক এবং তা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বল্পোন্নত সম্প্রদায় বা দেশ পেছনে পড়ে থাকবে না।
আমাদের যুবকদের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। দক্ষিণ
এশিয়ায় আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অন্যদের হাত
ধরতে হবে। সম্প্রদায় ও দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও পারস্পরিক
শ্রদ্ধা হচ্ছে চাবিকাঠি। আমাদের ভ্রান্ত ধারণা থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত
“সবার সাথে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয়”—এই নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ
বিশ্ব পরিমণ্ডলে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় অব্যাহত অবদান রেখে চলছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে সহায়তা করছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আমরা ভারতের সঙ্গে গঙ্গা নদীর
পানিবণ্টনের সমাধান করেছি। আমরা সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে ভারত ও মিয়ানমারের
সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নির্ধারণ করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন ভারতের সঙ্গে আন্তনদী নাব্যতা উন্নয়নে
কাজ করছে। আমরা ভারত থেকে ইন্টার গ্রিড সংযোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কিনছি।
আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের জন্য এ ধরনের সহযোগিতাপূর্ণ সংস্কৃতি
প্রয়োজন। অপরদিকে আমাদের বেসরকারি খাত স্বচ্ছ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে
পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে।’
চতুর্থ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অবশ্যই বন্ধুত্ব ও
সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের
জনগণের স্বার্থে ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক বাস্তবতার আমরা প্রশংসা করব। আমরা
স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ বন্ধ করে দিতে পারি না।’ তিনি
বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার বাবা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান বাঙালির মুক্তি–স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে তাদের প্রতি জোরালো আহ্বান
জানান।’ তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন এবং তাদের
ভালোবাসতেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে বাংলাদেশের উন্নয়ন বজায় রাখতে হলে তাদের
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
ডব্লিউইএফের সভাপতি বোর্জে ব্রেন্ডের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্ট
ছিলেন সিঙ্গাপুরের উপ-প্রধানমন্ত্রী হেং সোয়ি কিট, সেকুইয়া ক্যাপিটাল
ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শৈলেন্দ্র সিং, অ্যাপোলো হসপিটাল
এন্টারপ্রাইজের নির্বাহী সহসভাপতি শোবানা কারমিনেনি ও বুকিং ডট কমের
চেয়ারওমেন জিলিয়ান টানস।
সঞ্চালকের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে সংযোগ
প্রতিষ্ঠার ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তাঁর সরকার ১৯৬৫ সালের পর বন্ধ হয়ে
যাওয়া সংযোগগুলো পুনরায় চালু করার জন্য চেষ্টা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,
‘আমরা সব সময় এ নিয়ে চিন্তা করি। আমরা এই অঞ্চল এবং এর বাইরের অঞ্চলের
মধ্যে সেতুবন্ধ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এশিয়ান
হাইওয়ে ও এশিয়ান রেলওয়ে প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করছে। দারিদ্র্যকে এই
অঞ্চলের অভিন্ন শত্রু অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের সব দেশের
এই হুমকির বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই করা উচিত। আমাদের এটি করার সামর্থ্য রয়েছে
এবং আমরা নিশ্চয়ই এটি করব।’
রোহিঙ্গা ইস্যু প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে।
সিঙ্গাপুরের উপ-প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র্য বিমোচন ও সহযোগিতা বিনিময়ের
মাধ্যমে এই অঞ্চলকে আরও শক্তিশালী করার জন্য একযোগে কাজ করতে শেখ হাসিনার
ধারণার প্রশংসা করেন।