এক সময় তিনি মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজারে পাইকারি দরে সবজি সরবরাহ করতেন। পরে ওই বাজারে একটি দোকান নেন। ওই দোকানের আয় দিয়ে চলতো সংসার। একসময়ে ব্যবসার সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়ান তিনি। সড়কে থাকা ম্যানহোলের ঢাকনা চুরিরও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ছিনতাই চক্রের হোতা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন। পরে তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেন। যখন যে দল ক্ষমতায় তার ছায়ায় থেকে কয়েক বছরে হয়েছেন শতকোটি টাকর মালিক। অবৈধভাবে অর্থ আয় করে তা পাচার করেছেন বিদেশে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে টেন্ডারবাজি, ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য, দোকান দখল ও নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী সৃষ্টি করে তিনি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন মোহাম্মদপুর এলাকায়
। তিনি ঢাকা উত্তর সিটির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তিন বারের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান। শুক্রবার গ্রেপ্তারের পর গতকাল তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, বিদেশের ব্যাংকে তার ২৪ কোটি টাকা জমা আছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার আরও সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসবে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, প্রায় ২৪ কোটি টাকা তিনি থাইল্যান্ডের ব্যাংকে পাচার করেছেন। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে সুমন নামে তার এক পূর্বপরিচিত যুবকের মদের বার রয়েছে। ৯০-এর দশকে সুমন মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখন থাইল্যান্ডে বসবাস করেন। মিজানও মাঝে মাঝে থাইল্যান্ডে অবকাশে যেতেন। সেই সূত্র ধরে থাইল্যান্ডের ব্যাংকে তিনি ওই টাকা পাচার করেছেন। এছাড়াও র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার আরেক ক্যাসিনো ডন লোকমান হোসেন ভুঁইয়ার সঙ্গে ছিল তার যোগসাজস। তার সঙ্গে তিনি লিঁয়াজো করে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন বলে অভিযোগ পেয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম গতকাল মানবজমিনকে জানান, পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়েছে। আমাদের রিমান্ডে আসলে বাকি তথ্য পাওয়া যাবে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ১৯৮৯ সালে ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় এসে হাজারিবাগের বেড়িবাঁধ এলাকার এক স্বজনের বাড়িতে উঠেন হাবিবুর রহমান মিজান। গ্রাম থেকে ঢাকায় কাজের আশায় আসলেও কাজ না পেয়ে তিনি মানসিক হতাশায় ভেঙ্গে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি ছিনতাই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের খাতায় তিনি একজন দাগী আসামি হিসাবে পরিচিত পান। একপর্যায়ে মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার এলাকায় সবজি সরবরাহ করা শুরু করেন। কাওরানবাজার থেকে তিনি কাঁচা সবজি ক্রয় করে মোহাম্মদপুর এলাকার খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারী দরে বিক্রি করতেন। এক পর্যায়ে তিনি ওই মার্কেটে একটি দোকান খুলে বসেন। মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার মার্কেটের কিছু দোকানি এখনও তাকে ‘সবজি মিজান’ নামে চেনেন। তার ভাগ্যের চাকা খুলে যায় ১৯৯৪ সালে অবিভক্ত ঢাকা মহানগরের মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর। সূত্র জানায়, মিজান বিভিন্ন সময় প্রমোদ ভ্রমণে যেতেন থাইল্যান্ডে।

ওখানে যাওয়ার অনেকগুলো কারণও পেয়েছে র‌্যাবের গোয়েন্দারা। তার মধ্যে অন্যতম যে, তার অবৈধ টাকা থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের একাধিক ব্যাংকে রয়েছে। আর টাকা নেয়া, রাখার বিষয়টি তাকে সহযোগিতা করতেন সুমন মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি। র‌্যাব জানায়, সুমন ১৯৯০ সালে মোহাম্মদপুর এলাকার ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ১৯৯২ সালে মোহাম্মদপুর এলাকায় রাকিব হত্যা মামলার তিনি অন্যতম আসামি ছিলেন। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি আর ফেরেননি। ব্যাংককে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি বার-বি-কিউ। এছাড়াও সেখানে তার একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সূত্র জানায়, মিজানের পূর্ব পরিচিত ছিলেন সুমন। সুমন মাঝে মাঝে বিভিন্ন মাধ্যমে মিজানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। মিজান তার অবৈধ টাকা কোথায় রাখবেন তার পরামর্শ পেয়েছিলেন মূলত সুমনের কাছ থেকে। সুমন স্বউদ্যোগে তাকে থাইল্যান্ডের একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলেন। ওই টাকা নির্বিঘ্নে দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছেন মিজান। র‌্যাব জানায়, এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া ক্যাসিনো ডন লোকমান হোসেন ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন মিজানুর রহমান মিজান। মোহাম্মদপুর এলাকায় মিজান একাধিক ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া করে ক্যাসিনো সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। সেখানে যাতায়াত ছিল লোকমানের এমন তথ্য নিজেই মিজান র‌্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন।

‘পাগলা’ মিজানের বিরুদ্ধে ২ মামলা, সাত দিনের রিমান্ড
 
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে র‌্যাব। ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থানায় অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানার মামলা নং ৩১ ও শ্রীমঙ্গল থানার মামলা নং ১৫। এরমধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মানি লন্ডারিং মামলায় পাগলা মিজানকে গতকাল আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে। আদালত তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এর আগে সিআইডির পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন মিজানকে আদালতে হাজির করে রিমান্ড আবেদন করেন। এসময় আসামি পক্ষের আইনজীবী রিমান্ড রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিনের আবেদন করেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিভানা খায়ের জেসি রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে শুক্রবার বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় র‌্যাবের একটি টিম মিজানকে শ্রীমঙ্গল থেকে আটক করেছে। এসময় তার কাছ থেকে নগদ দুই লাখ টাকা, একটি পিস্তল ও চারটি গুলি উদ্ধার করা হয়। পরে ওই দিন বিকালে তাকে নিয়ে তার লালমাটিয়ার অফিসে ও মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেবের একটি বাসার ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়েছে। এসময় তার বাসা থেকে ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও এক কোটি টাকার এফডিআর জব্দ করা হয়।