আশির দশকের আমাদের ছাত্র রাজনীতির কালটা ছিল অন্ধকার, অপপ্রচার, মিথ্যে
আর বিভ্রান্তিতে ভরা। সামরিক স্বৈরশাসনের আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম
রাষ্ট্রীয়ভাবে বলতে গেলে প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। আমাদের প্রজন্মের বড় অংশকে
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানতে দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্র এবং সে সময়ের
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি, দুটো দলই এই অপরাধে অপরাধী।
শুধু ইতিহাস বিকৃতি করে কিংবা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেই স্বৈরাচারী জিয়া
কিংবা এরশাদ থেমে থাকেননি। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও চরম সর্বনাশ
ঘটিয়েছিলেন সে সময়। রাজনীতিকে তারা পণ্য বানিয়েছিলেন। কুরবানীর হাটের
গরু-ছাগলের মতো রাজনীতির মাঠে নীতিহীন ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদদের কেনা-বেচা হোত
তখন। সামরিক স্বৈরাচারের এই নষ্ট খেলার সুদূর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের
রাজনীতিতে, আজ এত বছর পরেও যা দৃশ্যমান। স্রেফ মুখের কথা আর জনসভায় মাইকের
সামনে গলাবাজির মধ্য দিয়ে এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব নয়। রাজনীতির এই
দুর্দশা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ছিল একদল নিবেদিত আদর্শবান সৎ
রাজনৈতিক নেতার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার।
পচাত্তর পরবর্তী জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার শাসনামলে বঙ্গবন্ধু মুজিব
ছিলেন মেঘে ঢাকা এক সূর্যের নাম। সময়ের পরিক্রমায় সেই মেঘ কেটে গেছে,
বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বঙ্গবন্ধু আপন শক্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছেন।
তাঁকে এখন আর অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। অবাধ তথ্য প্রযুক্তির যুগে
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম জানে, তাদের জাতির জনকের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান। তারা জানে, মানে এবং বিশ্বাস করে বাংলাদেশের স্থপতি শেখ
মুজিব, তাঁর নেতৃত্বেই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা
অর্জন করেছি। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা মানেই রাজনীতিতে নিজেকে
বিতর্কিত করা, সেটা দেশে-বিদেশে যেখানে হোক।
এরকম পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ এবং বর্তমান সরকারকে নিয়ে ষড়যন্ত্র কিন্তু
থেমে নেই। ষড়যন্ত্রকারীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে জাতির সামনে মাঝেমধ্যেই নতুন
তথ্য হাজির করছে। তার মধ্যে অন্যতম হল, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ভালো ছিল,
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যা-তা। যারা রাজনীতির বিশ্লেষণ বা মারপ্যাচের
হিসাব রাখেন না, সেইসব সাধারণ মানুষদের সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করার জন্য
চমৎকার একটা হাইপোথিসিস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঠেকাতে ব্যর্থ এইসব
ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেট এখন জননেত্রী শেখ হাসিনা। কারণ তারা ভালো করেই
জানেন, শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত বা ব্যর্থ করতে পারলে বঙ্গবন্ধু, একাত্তর এবং
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এ কথা সহজবোধ্য
যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার কঠিন লড়াইয়ে
শেখ হাসিনাই শেষ বাতিঘর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির
উত্তরাধিকার জামাত-বিএনপিপন্থীদের আজকের টার্গেট তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা।
এই প্রেক্ষিতে যে আলোচনাটা আজকে জরুরি, সেটা হলো বঙ্গবন্ধু এবং শেখ
হাসিনার রাজনীতির প্রেক্ষাপটটা কি একই রকমের ছিল? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের
রাজনৈতিক জীবনে তিনি শুদ্ধ রাজনৈতিক ধারার অনুশীলন করেছিলেন। পশ্চিম
পাকিস্তানে সামরিক-রাজনৈতিক শক্তির নষ্ট মিলন হলেও পূর্ব পাকিস্তানে
বঙ্গবন্ধু একটি শক্তিশালী, ন্যায্য রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সামর্থ্য
হয়েছিলেন। মুসলিম লীগ, জামাতের মতো পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু রাজনৈতিক
মিত্র থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি তখনো নষ্ট হয়ে যায়নি। বঙ্গবন্ধুর
রাজনৈতিক শত্রু-মিত্রও ছিল চিহ্নিত। দীর্ঘ তেইশ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের
পরিণতিতে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহবানে
জীবন বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবের
রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী,
কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলামের মত বিশ্বস্ত নেতৃবৃন্দ। ফলে রাজনীতির
সঠিক ব্যাকরণ মেনে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির দীর্ঘ বন্ধুর পথে হেঁটে বিজয়ী
হয়েছিলেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতির সংগ্রামটা ছিল ভিন্ন এক
লড়াইয়ের গল্প। পচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর, দীর্ঘ অনিশ্চয়তার
মুখে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি যখন দেশে ফিরেছিলেন, তখন বাংলাদেশে রাজনীতি আর
ছিল না রাজনীতিতে। রাজনীতি তখন পরিপূর্ণভাবে ভরে গেছে কদর্যতায়। সেই
রাজনীতির সেই প্রতিকূল স্রোতের বিপরীতে কঠিনতর এক লড়াইয়ে নেমেছিলেন শেখ
হাসিনা। রাজনীতির দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ী
তিনি যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন, ততদিনে রাজনীতির পাশাপাশি
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ, নড়বড়ে
হয়ে গেছে। সামরিক শাসনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ছোবলে নীল হয়ে গেছে বাংলাদেশের
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক অবস্থা থেকে
উত্তরণ সহজ ছিল না। তবু প্রধানমন্ত্রী হয়ে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শুরু
করেছিলেন, রাষ্ট্রের অনেক মৌলিক পরিবর্তনসমূহ দৃশ্যমান হওয়া শুরু হয়েছিল।
কিন্তু ২০০১ সালের বিতর্কিত সালসা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার সবকিছু তছনছ
হয়ে যায়। ক্ষমতায় এসে জামাত-বিএনপির সরকার দেশব্যাপী নজীরবিহীন
ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে সেই শাসনকালটি ছিল
নিকৃষ্ঠতম, নৃশংসতায় ভরপুর। যার ফলশ্রুতিতে ওয়ান ইলেভেনের
ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সরকারের আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তীতে দুই
বছরের রাজনীতির ব্যাপক উত্থান-পতন শেষে জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের
ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে পুনর্বার ক্ষমতাসীন হন।
এবারে জাতি শেখ হাসিনার মাঝে এক ভিন্ন প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে পায়,
যিনি অনেক পরিণত, প্রজ্ঞাবান এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। দারিদ্র্য, দুর্নীতি,
সুশাসনের ঘাটতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনতিসহ অসংখ্য
সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমস্যা চিহ্নিত করে
সমাধানে উদ্যোগী হন। পাশাপাশি আধুনিক ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে দেশের
উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চেয়েছেন। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে নীতিকথা
বেমানান, তিনি তাই দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্ষুধা মুক্তিকেই তার ক্ষমতার প্রথম
দফায় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তার সুফলও জাতি পেয়েছে। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে
দেশ থেকে মঙ্গা শব্দটা অনেক আগেই উধাও হয়ে গেছে। গত দশ বছরে দেশে
দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে, বেড়েছে শিক্ষার হার, উন্নতি হয়েছে স্বাস্থ্য
এবং অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের। শেখ হাসিনার নজীরবিহীন সাফল্যের পরও
সমালোচকের মুখ থেমে নেই। বিশেষ করে, জামাত-বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের
ধারাবাহিকতায় আগের মতই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতি এবং
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে অনেকেই বর্তমান সরকারের বিরূদ্ধে
সমালোচনামুখর। অনেকটা বাস্তবসম্মত এই সমালোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়,
দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের ফলে প্রশাসনে এবং সমাজে জাকিয়ে
বসা অশুভ শক্তিসমূহকে রাতারাতি নির্মূল করা সম্ভব ছিল না। বরং দারিদ্র্য
বিমোচন বা ডিজিলাইজেশনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে তিনি যদি শুরুতেই
দুর্নীতির বিরূদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতেন, আমার ধারণা, তাহলে প্রশাসন ও
সমাজের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তি কর্তৃক তিনি পদে পদে বাধাগ্রস্থ
হতেন। সেক্ষেত্রে সরকার পরিচালনা এবং দেশের উন্নয়নে তিনি কতটা সফল হতেন
বলা মুশকিল।
গত বছর সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে এক ঘরোয়া
আলোচনায় জাতীয় সংসদের বর্তমান চিফ হুইপ নুরে আলম চৌধুরী লিটন বলেছিলেন,
‘আওয়ামী লীগ তৃতীয় দফায় সরকার গঠন করতে পারলে দুর্নীতি দমন ও রাজনীতিকে
দুর্বৃত্তায়নমুক্তকরণ অভিযানকে অগ্রাধিকার দেবে’। আজকে বাংলাদেশে চলমান
অবৈধ ক্যাসিনো ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে লিটন চৌধুরীর সিডনিতে বলা কথার
প্রমাণ মেলে। তার মানে, বর্তমানের চলমান অভিযানটা হঠাৎ করে শুরু হওয়া কিছু
নয়, বরং অনেক আগে করা পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন। চলমান অভিযানে অবৈধ
ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্তি এবং দলে ফ্রিডম
পার্টি-জামাত-বিএনপি থেকে অনুপ্রবেশকারীদের অপরাধের খতিয়ান শুনে অনেকেরই
চক্ষু চড়ক গাছ! আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের শরীরে কলঙ্কের
এই দাগ বড় বেমানান। জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করে যাদের হাতে
নেতৃত্বের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ- যুব লীগ- ছাত্র লীগ-
কৃষক লীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের সেইসব নেতাদের অনেকেই সেই আস্থার প্রতিদান
দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। লোভ ও ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে এইসব নেতারা শেখ হাসিনার
সাথে বড় ধরণের প্রতারণা করেছেন। এইসব নেতারা দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত দলের
বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বঞ্চিত করে নিজেরা একেকজন গডফাদারে পরিণত
হয়েছেন। দলে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে অপরাধের সিন্ডিকেট গড়ে এরা রাষ্ট্রের
অঢেল অর্থকড়ি হাতিয়ে নিয়েছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ এইসব দুর্নীতিবাজদের বিরূদ্ধে দেশব্যাপী
অভিযান শুরু করেছেন। চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান নিয়ে রিসার্চ
ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক পরিচালিত এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৯৭% মানুষই
তার এই অভিযানকে সমর্থন করেন। তবে সমাজের যে অশুভ শক্তির বিরূদ্ধে তিনি
অভিযান শুরু করেছেন, তারাও পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ যে খুঁজবে না তা
নিশ্চিত করে বলা যায় না। চলমান অভিযানকে ব্যর্থ বা বিতর্কিত করবার
অপপ্রয়াসের ঝুঁকিও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চলমান অভিযানকে সফল
করতে সরকারকে তাই সতর্ক থাকতে হবে, এমন কী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
নিরাপত্তার বিষয়টিও আরো গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশের
বৃহত্তর স্বার্থে চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে শেখ হাসিনাকে জিততেই হবে,
আর জয়ের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তাঁর প্রতি জনগণের অব্যাহত সমর্থন।
লেখক: প্রবাসী চিকিৎসক